আম্বেদকর ও সামাজিক ন্যায়বিচার - Ambedkar on Social Justice

 

আম্বেদকর ও সামাজিক ন্যায়বিচার - Ambedkar on Social Justi   

 Ambedkar on Social Justice

  অতি সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক:

প্রশ্ন ১। কোন বছর কোথায় প্রথম অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধ করা হয়? 

উত্তর। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কোলাপুরে সর্বপ্রথম মহারাজার নির্দেশে অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধ করা হয়।


প্রশ্ন ২। কোথায় সর্বপ্রথম অস্পৃশ্যতাবাদের সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়? 

উত্তর। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে প্রথম অস্পৃশ্যতাবাদের সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। 


প্রশ্ন ৩। ভীমরাও রামজি আম্বেদকর কবে কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

উত্তর। ভীমরাও রামজি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে মাহার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। 


প্রশ্ন ৪। কত সালে আম্বেদকর বোম্বাই বিধান পরিষদের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন? 

উত্তর। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর বিধান পরিষদ মনোনীত প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। 


প্রশ্ন ৫। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রচার সংগঠিত করার একটি ঘটনা উল্লেখ কর। 

উত্তর। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রচার সংগঠিত করার একটি ঘটনা হলো নাসিক শহরের পবিত্রতম কালা রাম মন্দিরের প্রবেশের অধিকার অর্জন।


প্রশ্ন ৬। আম্বেদকর-এর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলির নাম কী? 

উত্তর। আম্বেদকর এর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলির নাম হল—ব্রিটিশ ভারতে প্রাদেশিক বিত্ত, যুক্তরাষ্ট্র বনাম স্বাধীনতা ইত্যাদি।


প্রশ্ন ৭। কোন আইন অনুসারে অসবর্ণ বিবাহ স্বীকৃত হয়? 

উত্তর।১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে অসবর্ণ বিবাহকে স্বীকৃত দেওয়া হয়।


প্রশ্ন ৮। ন্যায়বিচার বলতে কী বুঝি?

উত্তর। চুরি, ডাকাতি, নির্যাতন, খুন ইত্যাদি অপরাধমূলক ঘটনাগুলোর সাথে ন্যায়ের সম্পর্ক রয়েছে—উপযুক্ত শাস্তিবিধানকেই ন্যায় বিচার বলা হয়ে থাকে।


প্রশ্ন ৯। বিশ্ব সামাজিক ন্যায় বিচার দিবস কবে?

উত্তর। ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব সামাজিক ন্যায়বিচার দিবস হিসেবে পালিত হয়। 


প্রশ্ন ১০। ন্যায়বিচার দিবসের প্রধান লক্ষ্য কী?

উত্তর। রাষ্ট্রের সকল জনগণের কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সব ধরনের মৌলিক অধিকার আদান প্রদান করা একটি রাষ্ট্রের আবশ্যিক কর্তব্য। দরিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, উন্নয়নে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সকলের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই মূল লক্ষ্য।


প্রশ্ন ১১। আম্বেদকরের ধর্ম সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল?

উত্তর। আম্বেদকর অনুভব করেছিলেন হিন্দু ধর্ম সম্প্রদায় অনেক অবদমিত জাতের সমন্বয় গঠিত আর এই কারণে ভারতে সামগ্রিকভাবে দুর্বলতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।


প্রশ্ন ১২। ১৯৪২ সালের ৭ই আগস্ট ভারত সরকারের শ্রম দফতরের ভারপ্রাপ্ত মাননীয় ড. বি. আর আম্বেদকরের ‘নতুন দিল্লির শ্রমসংক্রান্ত যুক্ত অধিবেশনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা লেখ।

উত্তর। ১৯৪২ সালের ৭ই আগস্ট ভারত সরকারের শ্রম দফতরের ভারপ্রাপ্ত মাননীয় ড. বি. আর. আম্বেদকরের নতুন দিল্লির শ্রমসংক্রান্ত যুক্ত অধিবেশনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা হল—“এই ত্রিপাক্ষিক শ্রম-বৈঠকে উপস্থিত সবাইকে আমার পক্ষ থেকে সাদর অভিনন্দন। এই বৈঠকে আহ্বানে এত তৎপর সাড়া পাওয়াতে আমি এবং ভারত সরকার এতটাই অভিভূত যে তা অল্প কথায় প্রকাশ করা কঠিন। আপনারা বৈঠকের আমন্ত্রণ রক্ষায় যে কষ্ট স্বীকার করেছেন তা বলাই বাহুল্য।


প্রশ্ন ১৩। কোন আইন অনুযায়ী এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে এবং এক জাত থেকে অন্য জাত-এ পরিবর্তিত হওয়া আইনসিদ্ধ হয়।

উত্তর। Caste Disabilities Removal act (CDRA)-এর আইন অনুযায়ী এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে এবং এক জাত থেকে অন্য জাতে পরিবর্তিত হওয়া আইনসিদ্ধ হয়।


প্রশ্ন ১৪। আম্বেদকরের মতবাদের সাথে কোন ইউরোপীয় দার্শনিকের তুলনা  করা যায়।

উত্তর। আম্বেদকরের মতবাদের সাথে ইউরোপীয় দার্শনিকের নীৎসের তুলনা করা যায় ?


প্রশ্ন ১৫। আম্বেদকর যে শ্রেণিতে জন্মগ্রহণ করেন সেই শ্রেণিটিকে তিনি কোন কোন অভিধায় বর্ণনা করেন?

উত্তর। আম্বেদকর যে শ্রেণিতে জন্মগ্রহণ করেন সেই শ্রেণিকে তিনি বর্ণনা করেছেন—

'No caste Hindu', 'Protestant Hindu's, Non Conformist Hindu', ইত্যাদি অভিধায়।



 প্রশ্ন ১৬। 'Reverse discrimivation' কী?

উত্তর। অসম সমাজে সাম্য আনতে গেলে বিপরীত ধরনের অসাম্য আনতে হবে, যাকে বলা হয় Reverse discrimivation.


প্রশ্ন ১৭। আম্বেদকরের রাজনৈতিক মতবাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লেখ। 

উত্তর। আম্বেদকরের রাজনৈতিক মতবাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল— 

  1. আম্বেদকরের মতবাদ সাম্প্রদায়িকতা বা গোষ্ঠী মনোভাবমুক্ত অথচ ধর্ম বিরোধী।  
  2. সমস্ত ভারতবাসী জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সমান মর্যাদার অধিকারী এই বিষয়ে সাংবিধানিক ও আইনগত প্রস্তুতি থাকা দরকার।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক

প্রশ্ন ১। আম্বেদকর হিন্দু জাতি ও বর্ণব্যবস্থাকে অন্যায় বলে মনে করেন কেন তা লেখ।

উত্তর। ভারতে জাতি ব্যবস্থার অন্তনির্হিত সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে ড. বি. আর. আম্বেদকরের লড়াইয়ের একটি দিক হল ভারতের ব্রাক্ষ্মনবাদী হিন্দুধর্ম। তিনি বর্ণভেদ ব্যবস্থা ও জাতিব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেছেন। ভারতের জাতিব্যবস্থাকে অনুমোদনকারী ব্রাহ্মণবাদী হিন্দুধর্মকে সর্বাগ্রে তিনি নানাভাবে সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে, হিন্দুধর্ম বর্ণভিত্তিক প্রভৃতি বিশিষ্ট যা হিন্দুসমাজের অবক্ষয়ের মূল কারণ। হিন্দুধর্মের বর্ণগোষ্ঠীর বাইরে ব্যক্তির স্বতন্ত্র স্বীকৃতি না থাকায় ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হয়।

হিন্দুধর্মে বর্ণ ও অবর্ণের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব স্বীকৃতি পাওয়ায় হিন্দুরা একটি সুগঠিত জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। তাদের বিশ্বাস বেদ অপরিহার্য ও প্রাণবন্ত যা অযথার্থ ও অযৌক্তিক। হিন্দুধর্মে ঐহিক সুখ অপেক্ষা পরলোকিক মুক্তির সুখভোগ শ্রেয় বলে মনে করার ফলস্রুতিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পরলৌকিক মুক্তির আশায় ইহজগতের সুখকে বিসর্জন দিয়ে হিন্দু ধর্মের নানা অনুশাসনে নির্দ্বিধায় মেনে চলার দরুন হিন্দু ধর্মের অনুশাসনগুলি কঠোর থেকে কঠোরতর হয়েছে।

বলাবাহুল্য, হিন্দুধর্ম, বর্ণভেদ ব্যবস্থা ও জাতির ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা, নিন্দা ও জাতব্যবস্থার ভিত্তি স্বরূপ মনুস্মৃতি পোড়ানো প্রভৃতির মতো ঘটনার ফলশ্রুতিতে ভারতে এক প্রধান আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল।

প্রশ্ন ২। আম্বেদকর ভারতের নিপীড়িত জনগোষ্ঠী বলতে কাদের বুঝিয়েছেন? তাদের জন্য সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করতে তার প্রভাবগুলি কী ছিল?

উত্তর। ড. বি. আর. আম্বেদকর ভারতের নিপীড়িত জনগোষ্ঠী বলতে বুঝিয়েছিলেন ভারতের সেইসব অনুন্নত গোষ্ঠীর মানুষদেরকে, যাদেরকে ভারতের উচ্চবর্ণের মানুষেরা নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং যাদেরকে ভারতের উচ্চবর্ণের লোকেরা নানা অছিলায় উন্নত হতে দেয় না। 

আম্বেদকর ভারতের নিপীড়িত জনগোষ্ঠী বলতে বুঝিয়েছেন ভারতের সেইসব অনুন্নত গোষ্ঠীকে যারা জীবনযাত্রার পুণ্যকর্ম আয়োজন থেকে বঞ্চিত এবং যারা ভারতের উচ্চবর্ণের মানুষদের দ্বারা চরমভাবে অপমানিত, শোষিত, নির্যাতিত, অপমানিত ও অবহেলিত।

ভারতের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলির জন্য সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করতে আম্বেদকরে কতকগুলি সুনির্দিষ্ট প্রভাব ছিল।

প্রস্তাবগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল -

  1. ভারতের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলিকে হিন্দু দেবদেবীর মন্দিরে প্রবেশ করার অধিকার দেওয়া 
  2. উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বাড়িতে তাদের বেগার খাটা প্রথা রদ করা। 
  3. ভারতের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলির জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা করা। 
  4. ভারতের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো যাতে তারা সচেতন হতে পারে ও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। 

প্রশ্ন ৩। ড. বি. আর আম্বেদকরের অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রচার সম্পর্কে যা জান লেখ।

উত্তর। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে যে প্রচার শুরু হল তার মধ্যে দুটি ঘটনা সুবিদিত। প্রথমটি কোলাবা জেলার মাহাদে চৌদরে পুস্করিণী সত্যাগ্রহ। এই সত্যাগ্রহে ড. আম্বেদকরের নেতৃত্বে নীচ জাতির মানুষরা দলবদ্ধ বিক্ষোভে সামিল হয় ঐ পুস্করিণীর জল তাদের ব্যবহার করতে দেবার দাবিতে। জল নিতে গিয়ে অস্পৃশ্যদের মাথা ফাটল এবং ড. আম্বেদকর বাধ্য হলেন পুলিশ ডাকতে। 

        শেষমেশ অস্পৃশ্যদেরই জয় হল। এই আন্দোলনে পুস্করিণীর জল ব্যবহারের অধিকার কায়েম করার থেকেও বড় লাভ হল এক সুবদ্ধ হবার বোধ। এবং অস্পৃশ্যরাও যে মানুষ এই চেতনা বোধ তাদের চলিত করল মানুষ হিসাবে নিজেদের মুক্তির দিকে।


এই সাফল্যে তারা উদ্বুদ্ধ হল নাসিক শহরের পবিত্রতম কালারাম মন্দিরের প্রবেশের অধিকার অর্জনের জন্য। পাঁচ বছর ধরে তারা কালারাম মন্দিরে প্রবেশের জন্য সত্যাগ্রহ চালায়। বার্ষিক মেলা ও উৎসবে যাতে তীর্থ যাত্রীরা যেতে না পারে, তার জন্য তাদের বাধা দিতে লাগল এবং তা এত তীব্র হয়েছিল যে,মেলা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তারা এমন একটি ঘাটে স্নান করল, যে ঘাটে আগে তাদের নামতে দেওয়া হয়নি। এ ভাবে পবিত্র গোদাবরীর জল অপবিত্র করল। অনেকে বহু মহিলাসহ, জেল খাটল। অবশ্য সত্যাগ্রহ তুলে নেবার সময় পর্যন্ত তারা মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পায়নি। কিন্তু তারা দেখাল যে, তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং বর্ণ হিন্দুদের দেখাল যে প্রয়োজনে হিন্দু ধর্মের সাথে তারা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে পারে।

প্রবন্ধমূলক উত্তরভিত্তিক

প্রশ্ন ১। আম্বেদকরের সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে ধারণাটি ব্যক্ত কর। 

উত্তর। আম্বেদকরের ছিলেন বিংশ শতাব্দীর এমন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় যিনি ছিলেন সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অত্যন্ত পণ্ডিত ও বিচক্ষণ। এহেন ব্যক্তিটি ভারতের সামাজিক ন্যায়ের একান্ত অভাব লক্ষ্য করে পীড়িত বোধ করেছিলেন এবং সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থ হল -

  1. MR. Gandhi and the emancipation of the untouchables.(1942) 
  2. Who were the shudras. ( 1940).

সামাজিক ন্যায় সম্পর্কিত ধারণা :

(ক) ড. বি. আর. আম্বেদকরের মতে সামাজিক ন্যায় এক বিশেষ স্থানাধিকারী এটি অন্যান্য ন্যায়ের উৎস স্বরূপ, সমাজে যদি সামাজিক ন্যায় ভালো ভাবে বিরাজ করে তাহলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় আপনা আপনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।

(খ) তাঁর মতে সামাজিক সচলতা পথ সকলের কাছে অমুক্ত থাকলে তবেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে সামাজিক ন্যায়।

(গ) সামাজিক ন্যায় যথার্থ ভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হলে, সমাজে অবশ্যই ধর্মের ভূমিকা সীমিত হবে। কেননা তিনি বলেছেন, ধর্ম সমাজের জনগণের কাছে নিছক ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ না থাকে তা শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানিক ও আগ্রামনরূপে পরিণত হওয়া ধর্ম সমাজে সৃষ্টি করে বিভেদ ও অসাম্য। এই জন্য সমগ্র সমাজে একইরকম পুরবিধি থাকা আবশ্যক।

(ঘ) ভারতের বর্ণ বৈষমা ভিত্তিক সামাজিক কাঠামো বৃত্তমান নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করতে হলে কতগুলি প্রস্তাবকে কার্যকরী করা একান্ত জরুরি। এই প্রভাব হল। যথা— 

  1. নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলির পানীয় জলের জন্য সকলের সাথে পুকুর ব্যবহারের অধিকারপ্রদান।
  2. তাদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার সাধন প্রভৃতি।
  3. তাদের হিন্দু দেব-দেবীর মন্দিরে প্রবেশের অধিকার প্রদান।

সীমাবদ্ধতা :

(ক) সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে তার ধারণা মূলত ব্যস্ত হয়েছে বর্ণবৈষম্য ভিত্তিক ভারতের হিন্দু সমাজের পরিপ্রেক্ষিতেই। 

(খ) তার ধারণায় যেভাবে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে মাত্রা অধিক গুরুত্ব পথ সুগম হয়েছে বলা যেতে পারে।

(গ) সামাজিক ন্যায় বলতে আম্বেদকর যে শোষণহীন ও বিশেষ গোষ্ঠীর আধিপত্যহীন সমাজের ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন তা কোথাও প্রতিষ্ঠিত

হয়নি।

(ঘ) তার ব্যক্ত মতামত প্রবলভাবে ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ ফুটে উঠেছে।

(ঙ) তিনি ভারতের পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে যে আন্তরিকতা দেখিয়েছিলেন সেই আন্তরিকতা তিনি ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দেখাননি।

উপরিক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, তার সামাজিক ন্যায়ের ধারণায় বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা পাওয়া গেলেও তিনি একজন দক্ষ সমাজ তাত্ত্বিকের মত যেভাবে সামাজিক ন্যায়ের বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও অনস্বীকার্য।

প্রশ্ন ২। আম্বেদকর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে কী বুঝিয়েছেন। আম্বেদকরের ধর্ম সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল? আম্বেদকর রচিত কয়েকটি গ্রন্থের নাম লেখ।

উত্তর। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড :

অস্পৃশ্য জনগণের নেতা হিসাবে ড. বি. আর. আম্বেদকর ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকেন। ১৯২৬ সালে তিনি বোম্বাই বিধান পরিষদে মনোনীত প্রতিনিধি হিসাবে এবং পরে বোম্বাই বিধানসভায় নির্বাচিত হন তফশিলি জাতের প্রতিনিধি হিসাবে বোম্বাই শহর থেকে। লণ্ডনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে তিনবার এবং যুগ্ম সংসদীয় সমিতিতে, যে সমিতি ১৯৩৫ সালে ভারত সরকার আইন-এর খসড়া প্রণয়ন করেন, সেখানে তিনি তাঁর নিজের লোকেদের জন্য দাবি পেশ করেন।

তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, নতুন সংবিধানে তফশিলি জাতের স্বার্থরক্ষা নিয়ে গান্ধীর সাথে বিরোধিতা ড. আম্বেদকর তফশিলি জাতের জন্য চেয়েছিলেন কিছু রক্ষাকবচ। ব্রিটিশ সরকার কিছু রক্ষা কবচের ব্যবস্থা করতে যাওয়ার বিরুদ্ধে গান্ধীজি আমরণ অনশন আরম্ভ করেন। এই সংঘাতে পরিণামে স্বাক্ষরিত হল ‘পুনাচুক্তি’ যাতে নতুন সংবিধানে প্রাদেশিক বিধানমণ্ডলের নিম্নকক্ষে স্বীকৃতি পেল।

নতুন আইন অনুযায়ী অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ড. আম্বেদকর বোম্বাই-ও কিছুটা মধ্যপ্রদেশে তাঁর অনুগামীদের সংঘবদ্ধ করলেন। বোম্বাইতে তাঁর ইন্ডিপেনডেন্ট লেবার পার্টি তফশিলি জাতের জন্য সংরক্ষিত ১৫টির মধ্যে ১১টি আসনে জয়ী হয়। রত্নগিরি জেলায় অ-সংরক্ষিত আসনেও তাঁর দলের মনোনীত ২ জন হিন্দু প্রার্থী জয়ী হন। মধ্যপ্রদেশে জয়ী দলিত প্রার্থীদের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন অ-কংগ্রেসী ও ড. আম্বেদকরের অনুগামী।

আম্বেদকরের ধর্মসম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি :

ড. বি. আর. আম্বেদকর নুভব করেছিলেন যে, হিন্দু সমাজ যা চারটি বর্ণ এবং অনেক অবদমিত জাতের সমন্বয়ে গঠিত এবং এই গঠন-ই ভারতের সামগ্রিকভাবে দুর্বলতার কারণ এবং তার মধ্যে তিনি আটকে থাকতে চাইলেন না। 

তিনি হিন্দু সংস্কারবাদী সংগঠন 'জাত-পাত তোরফ মণ্ডল' তাঁকে তাঁদের বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতিত্ব করবার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধিবেশনটি পরিত্যক্ত হয়, কারণ সভাপতির প্রেরিত ভাষণে তিনি লিখেছিলেন, যে হিন্দু হিসাবে এই তাঁর শেষ বক্তৃতা যা মণ্ডলের পছন্দ হয়নি। তবে সেই ভাষণটি 'জাতের বলয়' নামে প্রকাশ করেন। শীর্ষনামেই জাত সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে।

কিন্তু যখন হিন্দু হিসাবে না থাকতে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও বৌদধর্ম, শিখধর্ম এবং খ্রিস্টধর্ম সহ অন্য ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশুনা করতে আরম্ভ করেন। তখনও তিনি অন্য কোনও ধর্মের ধর্মান্তরিত হবার কথা ঘোষণা করেননি। তিনি অনুভব করেন, অস্পৃশাদের তাকে তখনও প্রয়োজন। তাঁর ধর্মান্তরের প্রতিক্রিয়া সুদূর প্রসারী হতে পারে। তাঁর এবং তাঁর অনুগামীদের বিশ্বাস এমন একটি বিষয় যা ব্যক্তিগত এবং তিনি তার অনুগামীদের এই বিষয়ে প্রভাবিত করতে চান না। যখন তিনি অস্পৃশ্যদের নেতৃত্বে দেবার অধিকার অন্যদের হাতে তুলে দেবেন এবং কর্মজীবন থেকে অবসর নেবেন। তখন তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন। কিন্তু এখনও তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।

তাঁর রচিত গ্রন্থসুমহঃ

ড. বি. আর আম্বেদকর রচিত কয়েকটি গ্রন্থসমূহ—'টাকার সমস্যা (Problem of the Rupee), 'জাতের বলয়' (Annihilation of caste), পাকিস্তান সম্পর্কে ভাবনা' (Thought's of Pakistan), ‘যুক্তরাষ্ট্র নাম স্বাধীনতা' (Fedenation versus Freedom), 'ব্রিটিশ ভারতে প্রাদেশিক বিত্ত' (Provincial Finance in British India).
                                                                                                     কলমে - ড. বসুবন্ধু সেগুপ্ত

Post a Comment

2 Comments

Thank you for contacting jibonta.in! Please let us know how we can help you.