জন স্টুয়ার্ট মিল - স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্ৰ J. S. Mill on Liberty and Democracy

জন স্টুয়ার্ট মিল - স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্ৰ J. S. Mill on Liberty and Democracy


জন স্টুয়ার্ট মিল - স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্ৰ J. S. Mill on Liberty and Democracy

অতিসংক্ষিপ্ত  প্রশ্ন ও উত্তরঃ

১। “On Liberty" গ্রন্থটির লেখক কে?

উত্তর। জন স্টুয়ার্ট মিল-এর।


২। 'Considerations on Representatine Government' গ্রন্থটির লেখক কে?

উত্তর। জন স্টুয়ার্ট মিলের।


৩। ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায় জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্য কি?

উত্তর। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করা। 


৪। মিল কেন স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের প্রয়োজন বলেছিলেন?

উত্তর। মানব সমাজের বর্বর অবস্থা থেকে উন্নত স্তরে বিকাশের কারণে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

৫। মিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মানুষের কোন দিকটির  অধিক গুরুত্ব দেন? 

উত্তর। মানুষের মধ্যে থাকা অন্তর্নিহিত গুণগত দিকটির প্রতি অধিক গুরুত্ব দেন। 


৬। মিল উল্লিখিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কয়েকটি কাজ উল্লেখ কর। 

উত্তর। শিক্ষা বিস্তার, জনসাধারণের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া, সম্পত্তির ন্যায় সঙ্গত বণ্টনের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।


৭। বেন্থামের মানবচরিত্র কীরূপ? 

উঃ বেন্থামের মতে মানব চরিত্র প্রকৃতিগত ভাবে ভোগ পিপাসু ও প্রমোদ অভিলাষী। 


৮। উপযোগবাদের উৎপত্তি স্থল কোথায়?

উঃ উপযোগবাদের উৎপত্তি স্থল বৃটেনে।


৯। উপযোগবাদ ও উদারবাদের সম্পর্ক কি?

উঃ উদারবান হল সেই মত যা স্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠার ও আধুনিক রাষ্ট্র চর্চার ও প্রয়োগে রাষ্ট্রের পরিধির প্রসারে ব্যক্তি স্বাধীনতার সহায়ক হওয়াকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যাখ্যা করে। 

অন্যদিকে বেন্থামের রাষ্ট্রচিন্তায় এই উদারবাদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি হল উপযোগবাদ। উপযোগবাদ অনুযায়ী ব্যক্তি মানুষের সুখ ও আনন্দ বৃদ্ধি ও দুঃখকষ্ট খর্ব করন মৌলিক ও চূড়ান্ত লক্ষ্য।

১০।  "It may be better to be a Socrates dissatisfied than to be a fool satisfied”
উক্তিটি কার?

উঃ  উক্তিটি করেন জন স্টুয়ার্ট মিল


 ১১। আনন্দ ও দুঃখকে পরিমাপ করার জন্য বেন্থাম যে সকল উপাদানের দ্বারা পরিমাপ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন তার কয়েকটি উল্লেখ কর।


উঃ আনন্দ ও দুঃখকে পরিমাপ করার জন্য বেন্থাম যে সকল উপাদানের উল্লেখ করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-উগ্রতা, অবস্থান, পবিত্রতা,অন্তরঙ্গতা, বিশালতা প্রভৃতি। 


১২। বেন্থাম উল্লিখিত সহজ আনন্দগুলি কি কি?

উঃ বেন্থাম উল্লিখিত সহজ আনন্দগুলি হল সম্পদ, দক্ষতা, সুনাম,ধর্মানুরাগ,স্মৃতিশক্তি প্রভৃতি।

১৩। বেন্থাম উল্লিখিত সহজ কষ্টগুলি কি কি? 

উঃ বেন্থাম উল্লিখিত সহজ কষ্টগুলি হল যথা—বঞ্চিত হওয়া, দুর্নাম, শত্রুতা প্রভৃতি।

১৪। আইন প্রণয়নের নিউটন' কাকে বলা হয়?

উঃ জেরেমি বেন্থামকে আইন প্রণয়নের নিউটন বলা হয়। ১৫। বেঝামের মতে সমাজের সুখ কোন কোন উপাদান নিয়ে গঠিত?

উঃ বেন্থামের মতে সমাজের সুখ চারটি উপাদান নিয়ে গঠিত যথা—জীবন ধারনের উপায়, তৃপ্তি, ক্ষমতা ও নিরাপত্তা।
 

১। মিলের চিন্তাধারার সমকালীন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করো।

উত্তর। বিশ শতকের বিশ্ব ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক সামাজিক দিকগুলির বৈপ্লবিক জয়লাভ গুলির নিকট কেবল উনিশ শতকের রাজনৈতিক ইতিহাসের ঘটনাবহুতা, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রথা প্রতিষ্ঠানের পরিমাণ ও চরিত্রগত হার স্বীকৃত হয়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসী বিপ্লব প্রভৃতি ছিল রাজনৈতিক ভাবাদর্শীয় দিক থেকে সামন্ততান্ত্রিক থেকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আইনী ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে উত্তরণের প্রস্তুতি পর্যায়। উনিশশতকের সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবাদের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মার্কসবাদের উদ্ভব

উনিশ শতকের সামন্ততন্ত্রের ক্ষমতায় ভাগ বসাতে শুরু করে বুর্জোয়া বা বণিক সম্প্রদায় বা তাদের প্রতিনিধিরা। এই শতকে রাজনৈতিক চিন্তাধারায় রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি, সাংবিধানিক রূপের উদারতাসাধন, জনগণের গণতন্ত্রের অধিকারের চাপের নিকট নতিস্বীকার—এই সময়ের রাষ্ট্রতাত্ত্বিকদের চিন্তাধারায় প্রতিফলিত হয়।

শিল্প বিপ্লবের জোয়ার ও ফরাসী বিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপে পুঁজিপতিদের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের শিথিলতার প্রয়োজনীয়তা আবশ্যিক হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের অর্থনৈতিক অবাধ নীতির সমর্থনে যে রাষ্ট্রতত্ত্ব উপস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা ছিল তার পূরণে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উত্থাপন। এক্ষেত্রে জন স্টুয়ার্ট মিলের অবদান অনস্বীকার্য। 

ঊনবিংশ শতকে যুগ সন্ধিক্ষণে রাষ্ট্রতাত্ত্বিক জগতের প্রভাব তার উপর বর্তে ছিল। প্রথমাবস্থায় বেন্থামের ন্যায় হিতত্ত্ববাদী পরবর্ত্তী সময়ে হিতবাদের সমালোচনা করে বলে যুক্তিবাদী দুখের জীবন ভাল মূর্খ স্থূল জীবনের তুলনায়। আবার পরে ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি ব্যাখ্যা করেন এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন।

প্রতিটি পরিবর্তনে তৎকালীন মানবসভ্যতার আর্থসামাজিক পরিবর্তন বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। মধ্য যুগীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক বন্ধন থেকে অবাদ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মুক্ত অর্থনীতির প্রসারের অন্যতম শর্ত। তাই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে জনগণের নামে সমাজের উদীয়মান বণিক সম্প্রদায়কে মুক্ত অর্থনীতির উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন হয় যার তাত্ত্বিক সমর্থন লকের রাষ্ট্রতত্ত্বের চিন্তাধারায় পাওয়া যায়।

সবশেষে বলা যায়, শিল্পবিপ্লবের সাফল্যের পরবর্তী সময়ে উদ্ভুত চাহিদার রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবেশ গড়তে যে দার্শনিক চিন্তাধারার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তার মধ্যে জন স্টুয়ার্ট মিলের চিন্তাধারা অন্যতম।
প্রবন্ধমূলক উত্তরভিত্তিক:

১। সমালোচনাসহ স্বাধীনতা সম্পর্কে জন স্টুয়ার্ট মিলের ধারণা ব্যাখ্যা কর। স্বাধীনতা সম্পর্কে মিলের ধারনার দুর্বলতাগুলি উল্লেখ কর।

উত্তর। শিল্প বিপ্লবের সাফল্যের পরবর্ত্তী সময়ে উদ্ভুত চাহিদার রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবেশ গড়তে যে দার্শনিক চিন্তাধারা প্রাধান্য পেয়েছিল তার মধ্যে জন স্টুয়ার্ট মিলের চিন্তাধারা ছিল অন্যতম। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচর্চায় বেন্থামের পরবর্ত্তী উপযোগবাদকে নৈতিক ও লালনধর্মী দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা করে উপযোগবাদের নতুন রূপের উপস্থাপনা করেন জন স্টুয়ার্ট মিল। তিনি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের বৈষয়িক স্বার্থের দৃষ্টিকোণের পরিবর্তে নৈতিক দৃষ্টিকোনটির প্রতি গুরুত্ব দেন। মিল তাঁর ব্যাখ্যায় কেন্দ্রীয় আলোচনা রূপে প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীনতা ও অগ্রগতির ধারনা। মিলের রাষ্ট্রদর্শন প্রতিফলিত হয় তাঁর ‘On Liberty’, ‘Principles of Political Economy', 'Consideration of Representative Government' প্রভৃতি গ্রন্থে।

মিলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী অগ্রগতির প্রধান উৎস স্বাধীনতা। তাঁর মতে উপযোগবাদ বাস্তবায়নের ও প্রাপ্তির অপরিহার্য উপাদান হল স্বাধীনতা। 

মিলের মতে, কোন অধিকার যখন সবাই ভোগ করতে পারে তখনই সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার সুরক্ষিত হয়। তিনি বলেন, প্রতিটি ব্যক্তির বাক স্বাধীনতা রয়েছে। তিনি ব্যক্তির চিন্তা করার, অনুসন্ধান করার ও নিজস্ব মতামত প্রদানের অধিকার স্বীকার করেন।

ব্যক্তিগত স্বাধীনতা মিলের নিকট উন্নয়নের অন্যতম শর্ত ছিল। ব্যক্তি স্বাধীনতার পূজারী মিল ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা লঘু হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, ব্যক্তির কাজ যতক্ষণ অন্যের স্বার্থ ক্ষুন্ন করবে না ততক্ষণ তার উপর কোনরূপ নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। লোক সমাজের স্বার্থের পরিপন্থী ব্যক্তি স্বাধীনতায় মিল রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সমর্থন করেন।

 মিলের মতে, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয় হল যা স্বয়ং ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাঁর মতে, শাসনের রূপ যেমনই হোক যে সমাজে ব্যক্তির চিন্তা ও বাণীর স্বাধীনতা, ইচ্ছামতো জীবন যাপনের স্বাধীনতা, সমিতির স্বাধীনতা অনুপস্থিত তা স্বাধীন সমাজ নয়।

মিলের মতে, সমাজ ব্যক্তিগত স্তরে সৃষ্ট কীর্তির উপর ভিত্তি করে অগ্রসর হতে পারে। তিনি গুণগত দিক থেকে উৎকৃষ্ট ব্যক্তির অবাধ ও স্বাধীন বিকাশের পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর মতে, যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। উন্নত সৃষ্টিশীল মৌলিক মনের অধিকারী সংখ্যালঘু সুনিশ্চিত ভাবে সমাজকে উন্নততর পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করবে। তাঁর মতে, সন্তুষ্ট শুয়োর অপেক্ষা অসন্তুষ্ট মানুষ হওয়া ভাল। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী সংখ্যা গরিষ্ঠ মুর্খের চেয়ে অসুখী সক্রেটিস হওয়া ভাল।

মিল আরো বলেন ভুল বা অন্যায় মূলক মতামতকে দমন করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে থাকা যথার্থ নয় কারন বিভিন্ন মতামতের পারস্পরিক সংঘাতের মধ্য থেকে প্রকৃত মত বা সত্য প্রকাশিত হবে। তাঁর মতে, প্রতিটি ব্যক্তির অনুসরণ করার স্বাধীনতা, কোন উদ্দেশ্যে একত্রিত হওয়ার স্বাধীনতা যা অন্যের পক্ষে অনিষ্ট কর নয় এমন স্বাধীনতা স্বীকৃত। তিনি মানসিক অবস্থার বিকাশের জন্য স্বাধীন ভাবে অভিমত প্রদানের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেন। তাঁর নিকট কোন রাষ্ট্রের মূল্য নির্ধারিত হবে সেই রাষ্ট্র কতটা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি করতে সক্ষম হল তার উপর।

মিলের স্বাধীনতার ব্যাখ্যা বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়। অধ্যাপক বার্কার মিলকে স্বাধীনতা সম্পর্কে অন্তসার শূন্য বক্তা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

অনেকের মতে মিল ব্যক্তির মতামতের অবাধ স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিলেও কার্যসম্পাদনে অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা প্রদানে অস্বীকার করেন। 
স্যাবাইনের মতে, মিলের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা রাজনৈতিক সংগঠনের পরিবর্তনের আবেদন মাত্র; রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির নয়। সমালোচনা সত্ত্বেও ম্যাক্সে, ওয়েপার প্রমুখরা মিলের স্বাধীনতার তত্ত্বের গুরুত্ব পূর্ণ অবদান উল্লেখ করেন। 
প্রসঙ্গত একথা অনস্বীকার্য মিলের যাবতীয় ভাবধারা সমসাময়িক প্রয়োজন পূরণের তাগিদে উদ্ভুত হয়ে ছিল যা বর্তমান সময়কে উপকৃত করছে।

ঊনবিংশ শতকের রাষ্ট্রচর্চায় স্বাধীনতা সম্পর্কিত আলোচনার অন্যতম ব্যক্তিত্ব জন স্টুয়ার্ট মিল। নীতিশাস্ত্র, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি সকল দিক যা মানুষের জীবনের সাথে সম্পর্কিত তার সকল দিক মিল তাঁর একাধিক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। তাঁর লেখা 'On Liberty', 'Thoughts of Parliamentary Re forms’, ‘Consideration of Representative Government' প্রভৃতি গ্রন্থ সমূহ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় তার দৃঢ় প্রত্যয় ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে সীমিতকরণ তার আলোচনায় প্রতিফলিত হয়। উন্নয়ন বা অগ্রগতির অন্যতম শর্ত হিসেবে তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তির স্বার্থ সুরক্ষা যতক্ষণ লোকসমাজের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না করে ততক্ষণ ব্যক্তি স্বাধীনতায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন মিল। আবার অনেক সময় ব্যক্তির আত্মস্বার্থেও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে মিল সমর্থন করেছেন। বিশেষত যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ব্যক্তি স্বার্থকে প্রকৃত পক্ষে সুরক্ষিত করবে।

মিলের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা নানান দিক থেকে সমালোচিত হয়। 
জন স্টুয়ার্ট মিল - স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্ৰ J. S. Mill on Liberty and Democracy


প্রথমত, সমালোচকদের মতে মিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিত্তি বিনষ্ট করতে পারে এমন গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ আইনসঙ্গত দমনকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

দ্বিতীয়ত, মিল ব্যক্তি ও সমাজকে বিপরীত মেরুতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

তৃতীয়ত, কেণ্ডালের মতে, বাক্যের সীমাহীন স্বাধীনতা অথবা চিন্তার সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ এটি মিথ্যা উভয়সংকট যা মিল উপস্থাপিত করেছেন। 

চতুর্থত, কাওলিং মন্তব্য করেন মিল মানুষকে স্বাধীন করার পরিবর্তে নির্দিষ্ট মতবাদ যুক্তিবাদী উপযোগবাদের অনুগামী করতে চেয়েছেন।

পঞ্চমত, অধ্যাপক বার্কার মিলের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ব্যাখ্যার সমালোচনা করতে গিয়ে মিলকে অন্তরসারশূন্য স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ বক্তা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ষষ্ঠত, অনেকে মিলের স্বাধীনতার তত্ত্বকে পুরানো বোতলে নূতন মদের উপস্থাপন বলে সমালোচনা করেন।

সপ্তমত, মিলের স্বাধীনতার তত্ত্ব অনুন্নত নিম্ন জাতির বা জনগণের উপকার দানে অস্বীকৃত ফলত উপনিবেশগুলির উপর স্বৈরাচারী শাসনের ধারাবাহিকতার সমর্থনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে এই তত্ত্ব সমর্থন করে।

অষ্টমত, মিল চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন করলেও ক্রিয়া কলাপের ক্ষেত্রে তা স্বীকৃতি দেন নি। এরূপ মতামত গ্রহণযোগ্য নয়।

নবমত, মিলের স্বাধীনতার তত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ ও আধা-নিয়ন্ত্রণ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় চূড়ান্ত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে তিনি সক্ষম হননি। ব্যক্তি স্বাধীনতার ন্যায় সামাজিক ঘটনা লোকসমাজের বৈধ ও নৈতিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা সুরক্ষিত হবে তা মিলের ব্যাখ্যায় অবহেলিত হয়েছে।

সমালোচনা সত্ত্বেও মিলের স্বাধীনতা তত্ত্বের গুরুত্বের স্বীকৃতি দেন ম্যাকসে, ওয়েপার প্রমুখ চিন্তাবিদরা। মিলের স্বাধীনতা সম্পর্কিত চিন্তা ও ব্যাখ্যার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

২। জন স্টুয়ার্ট মিলের গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণা ব্যাখ্যা কর।


উত্তর। বুর্জোয়া রাজনৈতিক তত্ত্বে উপযোগিতাবাদ বিকাশে বেনথাম পরবর্তী ব্যক্তিত্ব হলেন জন স্টুয়ার্ট মিল। প্রাক্ একচেটিয়া পরিণত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ধারণা বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রতিফলিত হয় মিলের চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে। মিল সামাজিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিশ্লেষণে নিজের মূলগত সাবজেকটিভ-ভাববাদী, সংশয়বাদী ও অজ্ঞেয়বাদী স্থাপনা অনুসারে। রাজনীতি চর্চায় মিল গুরুত্বদেন আদর্শের ভূমিকায়। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঠিক, নৈতিক, নিদর্শন রচনা প্রয়োগে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির নির্বাচন ব্যবস্থার ব্যাখ্যায় মিল বৈষয়িক স্বার্থের পরিবর্তে নৈতিক ও লালন ধর্ম দৃষ্টিভঙ্গি ভিত্তিক ব্যাখ্যায় গুরুত্ব দেন।

মিলের চিন্তাধারায় ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারা মিশ্রণ দেখা যায়। একটা সময় বেন্থামের হিতবাদ আবার স্বল্পকাল পরে সেই হিতবাদের কঠোর সমালোচনা, পরিণত বয়সে তাঁর ব্যাখ্যায় ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে প্রবল যুক্তি প্রদান করছেন সাথে সাথে ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে সমর্থনে ব্যাখ্যা করছেন। কখনো গণতন্ত্রী ও স্ত্রী জাতির ভোটাধিকারের সমর্থক হিসেবে পাওয়া যায় আবার এই সাথে তাঁর আলোচনায় অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র অনুপযোগী—এরূপ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

মিল তাঁর সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির নিন্দা করেছিলেন। তাঁর মতে সেই সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশকে দমন করেছিলে। তাঁর ব্যাখ্যায় গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণার বিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ‘আত্মজীবনীতে। 

তিনি উল্লেখ করছেন, “আমার প্রত্যয়ে সত্যকার যে বদল ঘটাতে হয় নি, সেটা রাজনীতির ক্ষেত্রে একদিকে তা মানবজাতির লক্ষ্যের দিকে নরমপন্থী সমাজতন্ত্রের দিকে আরো কাছাকাছি যাওয়া, অন্যদিকে আমার রাজনৈতিক আদর্শকে, তখন যা ভাবা হয়েছিল সেই বিশুদ্ধ গণতন্ত্র থেকে তাকে গণতন্ত্রের সেই রূপে পরিণত করা যা আমি সূত্রবদ্ধ করেছি প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন’এ। মিলের উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণের পরিচয় পাওয়া যায় স্বাধীনতার পূজারী, গণতন্ত্রের সাধক, কর্তৃত্ববাদের কঠোর সমালোচক, সীমিত ভাবে একপ্রকার কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থনে ব্যাখ্যায়।

মিলের গণতন্ত্রবিষয়ক ব্যাখ্যা উত্থাপিত হয় কর্তৃত্ববাদ বিরোধী উদারনৈতিক হিসেবে। তাঁর লেখা Considerations on Representative Government নামক গ্রন্থে পাওয়া যায় তাঁর মতে আদর্শের দিক থেকে গণতন্ত্রই সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রব্যবস্থা। মিলের মতে majority বা সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই সুশাসন হবে এমন বিষয়টি সুনিশ্চিত নয়। মিল শর্তাধীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থন করেছিলেন। মিলের কাছে উদারনীতি যথেষ্ট উদার নয়। তিনি  সম্পূর্ণ উদারনীতিতে জনগণের হাতে শাসনক্ষমতা অর্পণে ইচ্ছুক নন। 

মিলের মত অনুযায়ী সমাজ যখন বর্বর অবস্থায় ছিল তখন স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের প্রয়োজন ছিল কিন্তু তাঁর সময়ে সমাজের আর্থিক সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে তাই রাষ্ট্রের ক্ষমতা সর্বাধিক পরিমাণে সঙ্কুচিত করে ব্যক্তি স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে হবে। তিনি যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের অস্থিত্ব স্বীকার করেছিলেন তার কারণ ক্রমবর্ধমান দারিদ্র ও আর্থিক বৈষম্য দূরীকরণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে। মিলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বাধিক অধিকসংখ্যক নাগরিকের সর্বাধিক অধিক পরিমাণ সুখ সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত মিল শর্তসাপেক্ষ যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাখ্যা করেন তাতে উদারভাবে জনগণের হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পণের পক্ষে মত দেন নি। তাঁর মতে জনগণ যে সরকার গড়তে চায় সেই সরকারের প্রকৃতি ও গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণ সচেতন কি না বা ইচ্ছুক কিনা বা সক্ষম কিনা—তা বিচার্য। তিনি সরকারের নিরাপত্তা বিষয়ে জনগণের ইচ্ছা ও সক্ষমতার প্রতি গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে যে দেশের মানুষের শাসন করা অপেক্ষা শাসিত হওয়ার মানসিকতা প্রবল, দেশের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা যথেষ্ট নয়, যে দেশের মানুষের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণে যথেষ্ট উদ্যোগ নাই—সেই সকল ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা নাই। তিনি আরো বলেন উদারনৈতিক গণতন্ত্রে মানুষ নিজেকে উন্নত করতে পারে। মিল পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ভোটাধিকারের পক্ষে মতামত প্রদান করেন।

মিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সংখ্যাগত দিকটির তুলনায় মানুষের অন্তর্নিহিত গুণগত দিকটির প্রতি অধিক গুরুত্ব দেন। প্রতিনিধি নির্বাচনে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সম্পত্তিগত যোগ্যতার প্রতি গুরুত্ব দেন। তিনি প্রকাশ্যে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন ব্যালট ব্যবস্থার বিলুপ্তির পক্ষে মতামত দেন। শিক্ষা ও সম্পত্তির ভিত্তিতে একাধিক ভোটদানের পক্ষে মত জ্ঞাপন করেন। প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠায় তিনি সংবিধান, আইনসভা, ভোটব্যবস্থা, প্রতিনিধিত্ব প্রভৃতির উপর করেন। অনেক তাঁকে অনিচ্ছুক গণতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করেন। গণতন্ত্র সম্পর্কে মিল যে উদারনৈতিক দর্শন প্রদান করেন তা সামাজিক উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্য সাধন করবে বলে ব্যাখ্যা করা হয়।
   কলমে - ড. বসুবন্ধু সেগুপ্ত

Post a Comment

0 Comments