স্বরাজ সম্পকে তিলক ও গাধীজি - Tilak and Gandhi on Swaraj

স্বরাজ সম্পকে তিলক ও গাধীজি - Tilak and Gandhi on Swaraj

স্বরাজ সম্পকে তিলক ও গাধীজি - Tilak and Gandhi on Swaraj

অতি সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিকঃ

প্রশ্ন ১। Hind Swaraj কার লেখা?

উত্তর। গান্ধীজির।

প্রশ্ন। ২। গান্ধীজির কোন গ্রন্থে স্বরাজ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়? 

উত্তর। Hind Swaraj গ্রন্থে? 

প্রশ্ন ৩। গান্ধীজির পূর্বে কে ভারতীয় চিন্তাধারায় স্বরাজ শব্দটি ব্যবহার করেন?

উত্তর। দাদাভাই নওরোজি। 

প্রশ্ন ৪। তিলকের স্বরাজ ধারণার সাথে কোন দার্শনিক প্রত্যয় জড়িত ছিল?

উত্তর। আত্মনিয়ন্ত্রণ।

প্রশ্ন ৫। তিলকের নিকট স্বরাজ কি?

উত্তর। প্রধানত বিদেশী শাসনের মুক্তি তবে মানুষের উন্নত নৈতিক প্রতিষ্ঠা ও আধ্যাত্মিক মুক্তির জীবনচর্চা।

প্রশ্ন ৬। গান্ধীজির নিকট স্বরাজ কি?

উত্তর। মূলত মানুষের নিজে নিজেকে পরিচালনা করার স্বাধীনতা পাবে—এটাই গান্ধীজির স্বরাজ।

প্রবন্ধমূলক উত্তরভিত্তিকঃ

প্রশ্ন ১। স্বরাজ সম্পর্কে গান্ধীজির মতামত ব্যাখ্যা কর।

উত্তর। ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারক বাহক হিসেবে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার যাবতীয় দিক সহ ব্যক্তি জীবনের প্রায় সবদিক নিয়ে আলোচনা করেছেন গান্ধীজি। রাজনীতিকে উদ্দেশ্য অর্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেও রাজনীতি মর্যাদা সম্পন্ন বলে ব্যাখ্যা করেননি। গান্ধীজির অছিবাদ, গঠনমূলক -কার্যক্রমের প্রস্তাব,বিকেন্দ্রিকৃত সমাজ, আত্মনির্ভর গ্রাম সংগঠন, ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ক আলোচনা বিশেষ মর্যাদার দাবী রাখে। আবার সত্যগ্রহ, অহিংসা ত্যাগ, নৈতিকতা এসকল হল উদ্দেশ্য অর্জনের মূল ও মর্যাদা সম্পন্ন পথ।

এসবের মধ্যে গান্ধীজির স্বরাজ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গান্ধীজির Hind Swaraj গ্রন্থে এসম্পর্কিত তাঁর মতামতের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

গান্ধীজির ব্যাখ্যা অনুযায়ী স্বরাজ বলতে বিদেশি শাসনের অবসান নয়। তাঁর মতে মানুষের নিজের কল্যাণ নিজের দ্বারা সাধিত হবে—এটাই স্বরাজ। স্ব-অধীনতাইকে গান্ধীজি স্বরাজ বলে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরে স্বরাজ আসে না। গান্ধীজি বলেন মানুষের পরনির্ভরতা দূর করতে প্রয়োজন নৈতিক শক্তি। তাঁর মতে কর্তৃত্ব তাঁর ক্ষমতা অপব্যবহার করলে যখন সবাই তা প্রতিরোধ করার সক্ষমতা অর্জন করবে মাত্র কয়েকজন না করে তখন যথার্থ স্বরাজ সম্ভব। এক্ষেত্রে উন্নত নৈতিক ধারণা থেকে সরে গান্ধীজি রাজনৈতিক পর্যায়ে স্বরাজকে বাস্তবতা দেওয়ার প্রয়াস করেছেন। তাঁর মতে এজন্য সর্বসাধারণের রাজনৈতিক শিক্ষা প্রয়োজন, যার দ্বারা কর্তৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা ও মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করবে।

তাঁর মতে মানুষে মানুষে সুস্থ সামাজিক সম্পর্ক মানুষের স্বাধীনভাবে স্বনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতেও পারে। গান্ধীজির স্বরাজ সম্প্রদায় গত ভিন্নতা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, জাত-পাত প্রভৃতি ভিন্নতা বজায় রেখে বাস্তবায়িত হবে না। শাসক কোন ধর্ম বা জাতির প্রতিনিধি — সেটা বড় নয় গান্ধীজির নিকট গুরুত্বপূর্ণ হল শাসক জনকল্যাণ সাধনে সচেষ্ট কতটা তার উপর। গান্ধীজির স্বরাজ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নীতিগত ও সমাজগত ন্যায় প্রতিষ্ঠা-ই মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্যগুলি অর্জিত হওয়ার প্রতিফলন ন্যায় পরায়ণতার মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। তাঁর মতে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও ধর্মনীতি—এই চারটির সমন্বিত প্রকাশ ন্যায় রাজ্যের চতুবর্গ পূরণ করবে। প্রসঙ্গত গান্ধীজি ধর্মনীতির উপর গুরুত্ব দেন কারণ ধর্ম মানুষকে যে নিয়ন্ত্রিত জীবন চর্চায় অভ্যস্ত করে তা স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।

প্রসঙ্গত গান্ধীজির স্বরাজ ধারণা গণতন্ত্রের ব্যাপক রূপটির উপর আস্থা প্রতিস্থাপন করে। তাঁর ব্যাখ্যায় এই ব্যবস্থায় ক্ষমতা জনগণের অভিমুখে ধাবিত করতে হবে। তাঁর স্বরাজ ধারণা রামরাজ্য, তথা রামায়ণের সুশাসক রাম ও কুশক্তি রাবণ এবং সুশাসক বা শুভ শক্তি পরাজিত করতে কুশক্তিকে—এরূপ ব্যাখ্যাই তাঁর নিকট প্রাধান্য পেয়েছিল। কোন ঐতিহাসিক চরিত্রে সত্য মিথ্যা তিনি যাচাই করার গুরুত্ব দেন নি। এই স্বরাজ বা রামরাজ্যই প্রকৃত গণতন্ত্র যা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভৃতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করবে। এই স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে হিন্দুরা রামরাজ্য বললে ইসলামরা খুদাই রাজ বা খ্রিস্টানদের ‘Kingdom of God on Earth' নামে পরিচিত।

গান্ধীজি ব্যাখ্যায় রামরাজ্য কোন হিন্দু রাজ্য নয় এটি একটি ধর্ম, সময় স্থান নির্বিশেষে সুশাসন ব্যবস্থার প্রতীক। মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ পর্যায়ে সম্পর্কিত ব্যাখ্যা। গান্ধীজির নিকট স্বরাজ হবে সেই গণতন্ত্র যা আপামর জনসর্বোরণের কল্যাণের লক্ষ্যে পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা।

তবে বর্তমান নঞর্থক রাজনীতি গান্ধীজি স্বরাজ ধারণার অপব্যাখ্যা করে সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট করে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ প্রয়োগে ভারতীয় রাজনীতিকে জর্জরিত করে গান্ধী তত্ত্বের অপপ্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। তথাপি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়ন ও রাষ্ট্রীয় সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিকল্প হিসেবে গান্ধীজির স্বরাজ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা বিশেষ গ্রহণযোগ্যতার দাবি রাখে। 

প্রশ্ন ২। বাল গঙ্গাধর তিলকের স্বরাজ সম্পর্কিত ধারণার ব্যাখ্যা কর।

উত্তর। ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক ও বিংশ শতকের প্রথমের দিকে উপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনের দুর্বলতা চরমপন্থী রাজনীতি বা আন্দোলনের জন্ম দেয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এই চরমপন্থা দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম পুরোধা ছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলক। মহারাষ্ট্রের শিবাজী দ্বারা মোঘল আধিপত্য বিলুপ্তির পথ অনুসরণ করার পক্ষপাতী তিলক গণপতি উৎসব কে জাতীয়তাবাদী রূপ দেওয়ার প্রয়াস করেন। তিনি তাঁর মতামত প্রকাশ করেন ‘Keshari' এবং 'Maharatta' পত্রিকায়।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ‘স্বরাজ’ তাঁর প্রধান ও প্রথম লক্ষ্য ছিল। সেই উদ্দেশ্যে তিনি গড়ে তোলেন Home Rule League (1916) স্বদেশি আন্দোলন (1905) থেকে তিনি সারা দেশব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের নীতিবোধ সমন্বিত এই ব্যক্তিত্ব মহারাষ্ট্রে জাতীয়তাবোধ জাগরণের প্রধান হলেও তাঁর কাজের পরিধি ছিল সারাদেশ ব্যাপী এমন কি বিদেশে ও ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল বক্তব্য সম্প্রচারের উদ্যোগ নেন। 

হোমরুল লীগের আন্দোলনের মূখ্য লক্ষ্য হিসেবে নিঃশর্ত স্বরাজ দাবি—তাঁর নিকট ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমি জাতীয়তাবাদের সাথে সাদৃশ্য রেখে তিনি স্বরাজের ধারণা প্রতিষ্ঠা করে। ভারতীয় অতীত ঐতিহ্য মান্য করলেও প্রতিষ্ঠানিক উপাদানগুলি ও রীতিনীতিগুলি তাঁর নিকট গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তিলনের স্বরাজ ব্যাখ্যায় দার্শনিক ভিত্তি ছিল প্রতিটি ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণ।

বিদেশি শাসন থেকে মুক্তিই তাঁর স্বরাজের অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল। তাঁর ব্যাখ্যায় শাসক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে স্বরাজ্যে। এই স্বরাজ্যে মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ও আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্য জীবন পরিচালনা হবে। 

তিলকের নিকট 'স্বরাজ্য কেবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও বিদেশী শাসকের হাত থেকে মুক্তি নয় তৎসহ ব্যক্তিমানুষের জীবনচর্চা। তাঁর মতে পরনির্ভরতা দূর করে স্বাবলম্বী হয়ে শাসকের নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করতে হবে। স্বদেশী ধারণার মাধ্যমে এই মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে বলেই তিনি ব্যাখ্যা করেন। তাঁর ব্যাখ্যা দেশের কোন অংশ তাদের নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি, গৌরবের প্রচার ঘটিয়ে সর্বভারতীয় জাতীয় ঐক্যের অভিমুখী করবে। 

স্বরাজ হবে সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ। স্বরাজ হবে সেই সুশাসন যেখানে আইনের শাসন শাসক ও শাসিত উভয়ের জন্য সমান প্রযোজ্য। নৈতিকতার দিক থেকে স্বরাজ্য হল মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করে সমাজ সচেতন মানুষ গড়ে তোলার নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা।

সর্বোপরি বলা যায়, ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তিলকের স্বরাজ ধারণা ও বাস্তব প্রয়োগের প্রয়াস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। জাতীয়তা বাদকে সামনে রেখে আত্মসচেতন ঐক্যমুখী মনোভাব গড়ে তোলার প্রয়াসে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য লাল-বাল-পাল একত্রিত হয়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে ব্যাপকতম ‘স্বরাজ’ আন্দোলনে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়।

                                                                                                        কলমে - ড. বসুবন্ধু সেগুপ্ত

Post a Comment

0 Comments