প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্প - বাজীকর / The story of Prabhatkumar Mukherjee - Bajikar

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্প - বাজীকর
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্প - বাজীকর  


প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্প - বাজীকর / The story of Prabhatkumar Mukherjee - Bajikar                         

প্রথম পরিচ্ছেদ।। "ভগবান আর কষ্ট দিও না" ।

 লোকটির বয়স ৬০ বৎসরের নিতান্ত কম হইবে না। গালের মাংসগুলি ঝুলিয়া গিয়াছে চুল ও গোঁফ বিলকুল পাকা, লাঠি ধরিয়া একটু কোঙা হইয়া পথ চলেন। দেহের বর্ণটি এককালে খুব সুন্দর ছিল, এখন মলিন হইয়াছে, স্থানে স্থানে মেছেতা পড়িয়াছে, তথাপি এখনও রাগিলে গাল ও কপাল হইতে লাল আভা ফুটিয়া বাহির হয়। চোখ দুটি বড় বড়, তবে সাদা অংশগুলি ঘোলাটে হইয়া গিয়াছে। এককালে ইনি সুপুরুষ বলিয়া গণ্য ছিলেন সন্দেহ নাই।

ইঁহার নাম শ্রীরামরতন বসু–অথবা প্রোফেসার বোস। বাড়ী বরিশাল জেলায়। আজ ৭/৮ দিন হইল রঙ্গপুরে আসিয়াছেন; স্থানীয় টাউন হল ভাড়া লইয়া প্রতি সন্ধ্যায় ম্যাজিক দেখাইতেছেন। বাজারের নিকট টিনের ছাপ্পরওয়ালা দুইখানি দর্শাঘেরা ঘর ভাড়া লইয়াছেন। : একখানিতে রান্না হয়; অপরখানির এক দিকে এক তক্তপোষে তিনি ও তাঁহার সহকারী যুবক, সম্পর্কে ভাগিনেয় কুলদাচরণ শয়ন করেন। অন্য দিকে আর একখানি তক্তপোষের উপর তাঁহার ম্যাজিকের আসবাব পত্র স্তূপীকৃত—তাহারই প্রান্তভাগে এক হাত চওড়া খালি স্থানটিতে ভৃত্য হরিদাস গুটিশুটি হইয়া কোন মতে রাত্রি যাপন করে। তক্তপোেষ দুইখানি জরাজীর্ণ ও ছারপোকা-বহুল, তথাপি তাহার জন্য স্বতন্ত্র ভাড়া দিতে হয়।

অপরাহু কাল। ফাল্গুন মাস, কিন্তু এখনও রঙ্গপুরে বেশ শীত আছে। দিবানিদ্রা হইতে উঠিয়া, বালাপোষ গায়ে দিয়া বসুজা মহাশয় ধূমপান করিতেছেন- আর, ভাবিতেছেন। বারান্দায় হরিদাস বসিয়া সশব্দে মশলা বাটিতেছে; বামুন ঠাকুর তরকারী কুটিতেছে।

কুলদা গিয়াছে বিজ্ঞাপন বিলিকরিতে। একখানি তৃতীয় শ্রেণীর ঠিকাগাড়ী ভাড়া করিয়া বেলা ২টা হইতে ৫টা পর্যন্ত সহরময় সে “অদ্যকার অত্যাশ্চর্য্য" ম্যাজিক খেলার বিজ্ঞাপন বিলি করিয়া বেড়ায়, বাড়ীর ছাদে ইংরাজি বাজনা বাজিতে থাকে।

ব্রামরতন বসু তামাক খাইতেছেন, আর ভাবিতেছেন— ভাবিয়া কোনও কূল কিনারা পাইতেছেন না। গৃহে তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী এবং দুইটি কুমারী কন্যা। উভয় কন্যার বিবাহকাল উত্তীর্ণ হইয়াছে, কিন্তু অর্থাভাবে বিবাহ দিতে পারিতেছেন না। বড়টির ত বৈশাখ নাগাদ না দিলেই নয়। অন্ততঃ পক্ষে একটি হাজার টাকার প্রয়োজন, কিন্তু আর্থিক অবস্থা শোচনীয়।

রামরতন যৌবন কালে বাড়ী হইতে পলাইয়া গিয়া প্রসিদ্ধ বাজীকর ভুরে খাঁ ও চাঁদ খাঁ ভ্রাতৃদ্বয়ের সাকরেদী করিয়া ম্যাজিক শিখিয়াছিলেন। তাহার পর গৃহে ফিরিয়া বিবাহ করেন। কিছু পৈত্রিক জোৎজমি ছিল, তাহারই উপর নির্ভর করিয়া সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করিতেন। 

কিন্তু তাঁহার সেই প্রথম পক্ষের স্ত্রী, স্বামীকে একে একে তিনটি কন্যা উপহার দিলেন। সে তিনটির বিবাহ দিতে দিতে জোৎজমিগুলি সমস্তই গেল। উপরন্তু কিছু ঋণও হইল। ঋণদায়ে ব্যতিব্যস্ত হইয়া, স্ত্রীর অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া, রামরতন কলিকাতা হইতে ম্যাজিকের সরঞ্জাম কতক ক্রয় করিয়া আনিলেন। তখন হইতে মাঝে মাঝে ম্যাজিক দেখাইতে বাহির হন। এই উপায়ে ঋণদায় হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছেন।

তখন তিন চারিমাস ম্যাজিক দেখাইয়াই সম্বৎসরের খোরাক সংগ্রহ করিতে পারিতেন। কিন্তু ইদানীং ৫/৭ বৎসর হইতে এ ব্যবসায়ে কিছু মন্দা পড়িয়াছে। লোকে আর ম্যাজিক দেখিতে বড় চাহে না—তাহারা চাহে থিয়েটার কিংবা সার্কাস। সুতরাং এখন বৎসরে ছয় মাসেরও অধিক ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়; কিন্তু বয়স ত দিন দিন কমিতেছে না–বাড়িয়াই চলিয়াছে। আর সে শক্তি-সামর্থ্য নাই—এ দেশ ও দেশ ছুটাছুটি করিবার ক্ষমতা নাই। কিন্তু না করিয়া উপায়ও ত নাই!

রঙ্গপুরে আসিয়া প্রথম দুই একদিন রোজগার মন্দ হয় নাই। দুইদিনে শতাধিক টাকার টিকিট বিক্রয় হইয়াছিল। পল্লীগ্রাম হইতে মোকদ্দমা প্রভৃতি উপলক্ষ্যে কৃষক-শ্রেণীর যে সকল লোক শহরে আসে—স্থানীয় ভদ্রলোকরা যাহাদিগকে “বাহে” বলেন, —তাহারা ঐ দুইদিন অনেকেই চারি আনার টিকিট লইয়া “তাম্সা” দেখিতে আসিয়াছিল। কিন্তু এ তামাসায় কোনও স্ত্রীলোক না থাকায় তাহারা চটিয়া গেল। বলাবলি করিতে লাগিল—“না একটা বিটিছাওয়া, না কিছু, শুধুই পয়সা দিমু –হঃ!”—বিগত পৌষ মাসে এখানে এক সার্কাস কোম্পানি আসিয়াছিল; গোলাপী রঙের গেঞ্জি পরিহিত যুবতীগণের ব্যায়ামলীলা দেখিয়া খুব খুশী ছিল; এখন লোলচৰ্ম্ম বৃদ্ধের বক্তৃতা ও বুজরুকি তাহাদের পছন্দ হইল না।

প্রতিদিন ঘর ভাড়া, তক্তপোষ ভাড়া, চারিজন লোকের আহারের ব্যয়, বিজ্ঞাপন ছাপার বায় ও তাহা বিতরণের জন্য গাড়ী ভাড়া, বাজনাওয়ালাদের মজুরি, টাউন হলের ভাড়া ও আলো-খরচ ত বড় সামান্য নয়। লোক না জুটিলে এমন ভাবে কয়দিন চলিবে? খরচপত্র কুলাইয়া প্রতিদিন অন্ততঃ ২০/২৫ টাকা উদ্বৃত্ত না থাকিলে, বৈশাখ মাসে কন্যার বিবাহের আশা যে মরীচিকায় পরিণত হয়। এই সকল কথা ভাবিতে ভাবিতে বৃদ্ধের মনটি বড়ই অবসন্ন হইয়া পড়িল। তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “হে ভগবান! আর কষ্ট দিও না।"

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।।    "ছেলেগুলো ভারি জ্যাঠা হইয়াছে"।

প্রথমে বাদ্যের, ক্রমে তাহার সহিত ছক্কড়ের চক্রশব্দ শ্রুতিগোচর হইল; কলদা ফিরিয়া আসিতেছে। গাড়ী হইতে নামিয়া কুলদা গাড়োয়ান ও বাজনাওয়ালাদের ভাড়া প্রভৃতি মিটাইয়া দিয়া, আগামী কল্য ঠিক দুইটার সময় তাহাদের পুনরাবির্ভাব প্রার্থনা করিল। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতেই রামরতন জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইস্কুলে কি রকম হল?" কুলদা ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, “বড় সুবিধে নয়।” কোন্ কোন্ ইস্কুলে গিয়েছিলে?” "জেলা ইস্কুল টাউন ইস্কুল, কৈলাসরঞ্জন—তিনটেতেই গিয়েছিলাম। মোট ৫২খানি টিকিট বিক্রি হয়েছে।" 

“তিনটে ইস্কুলে কিছু না হবে হাজার বারোশো ছেলে, মোটে ৫২খানি টিকিট বিক্রি!  সবই চার আনা বোধ হয় ?” কুলদা বলিল, "না, চার আনাও আছে, আট আনাও আছে।"—বলিতে বলিতে পকেটে হাত দিয়া সে গোটা কয়েক আধুলি ও সিকি বাহির করিয়া তক্তপোষের উপর রাখিলরামরতন সেগুলি গণিতে লাগিলেন। কুলদা বলিল, "ছেলেগুলো বলে, ম্যাজিক আর দেখব কি, ও ত আমরাও করতে পারি।”

রামরতন বলিলেন “হ্যাঁঃ—ভারি ত মুরোদ। কই, কর না বেটারা, দেখি। ছেলেগুলোও সব জ্যাঠা হয়ে উঠলো। আমরা যখন ইস্কুলে পড়তাম, মনে আছে, ম্যাজিক হচ্চে শুনলে ত উন্মত্ত হয়ে উঠতাম। একেবারে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। মায়ের বাক্স ভেঙ্গে পয়সা নিয়ে ম্যাজিক দেখতে ছুটতাম। আর আজ ছোঁড়াগুলো বলে কিনা ম্যাজিক আর দেখব কি! হায় রে কলিকাল।” —বলিয়া তিনি উদাস দৃষ্টিতে সম্মুখে রাজপথের পানে চাহিয়া রহিলেন। কুলদাও বিষণ্ণ মুখে তক্তপোষের একপ্রান্তে বসিয়া রহিল। অল্পক্ষণ পরে বলিল, “আচ্ছা মামা, ইস্কুলের ছেলেদের অর্থমূল্য করে দিলে হয় না?” রামরতন বলিলেন, “আসবে কি? যদি বেশী ছেলে আসে ত হাপ প্রাইসে আপত্তি নেই।” কুলদা বলিল, “হাপ প্রাইস হলে অনেক ছেলে আসে বোধ হয়।” 

“আচ্ছা, কাল থেকে না হয় তাই করে দাও। সকালে উঠেই হ্যান্ড বিলটি ছাপতে দিয়ে এস।”কুলদা একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “ছাপাখানায় ২০/২২ টাকা বাকী পড়ে গেছে; তারা বলেছে ধারে আর ছাপাবে না। কাল গোটা পনের টাকাও অন্ততঃ দিতে হবে।”

“দেখি আজ কি রকম হয়।” বলিয়া বৃদ্ধ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। পরদিন বিদ্যালয়ের বালকগণের জন্য টিকিট অবমূল্য করা হইল, কিন্তু তাহাতে বিশেষ ফল দর্শিল না।তৎপরদিন ঘোষিত হইল—“অদ্য শেষ রজনী! শেষ রজনী!! শেষ রজনী!!! সকলে আসুন, দেখুন, বিস্মিত হউন।” তাহাতে অন্য দিন অপেক্ষা ৫/৭ টাকা মাত্র বেশী পাওয়া গেল। পরদিন আবার বিজ্ঞাপন বিলি হইল—“বহু সম্ভ্রান্ত ও পদস্থ মহোদয়গণের বিশেষ অনুরোধে, প্রোফেসর বোস অদ্য তাঁহার যাত্রা স্থগিত রাখিলেন। অদ্য রজনীতে নূতন নূতন খেলা, নূতন নূতন বিস্ময়, কেহ কখনও দেখেন নাই, শোনেন নাই, স্বপ্নেও ভাবেন নাই। এই শেষ, এই শেষ।” কিন্তু রঙ্গপুরের ভবী তাহাতেও ভুলিল না।

সেদিন রাত্রে ম্যাজিক হইতে ফিরিয়া বাসায় আসিয়া রামরতন একখানি ডাকের পত্র পাইলেন। ইহা তাঁহার স্ত্রী লিখিয়াছেন।পত্র পড়িয়া বৃদ্ধ মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। স্ত্রী লিখিয়াছেন, ছোট মেয়েটির এগারো দিন জ্বর, ডাক্তার বলিয়াছে বিকারে দাঁড়াইতে পারে, ঘরে একটি পয়সা নাই, পাড়াপ্রতিবেশীর নিকট কর্ম্ম করিয়া দিন ডাক্তারের ভিজিট দেওয়া হইয়াছে; অর্থাভাবে চিকিৎসা ও পথা বন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে। তিনি আরও লিখিয়াছেন—“তুমি যদি দিন কতকের জন্য একবার 

আসিতে পার ত বড়ই ভাল হয়। যদি নিতান্তই আসিতে না পার তবে অন্ততঃ পঁচিশটি টাকা পত্রপাঠ মাত্র আমায় পাঠাইয়া দিবে, ইহাতে কোনমতে যেন অন্যথা না হয়।” হরিদাস তামাক সাজিয়া আনিয়া দিল। রামরতন হুঁকা হাতে লইয়া বসিয়া রহিলেন। এই মেয়েটা তাহার বড় আদরের; তাহার রোগশয্যা যেন চোখের সমুখে দেখিতে লাগিলেন। কল্পনাচক্ষে আদরিণী কন্যার রোগখিন্ন মুখখানি দেখিতে, তাঁহার বাস্তব চক্ষু দুইটিতে জল ভরিয়া আসিল।কুলদা ম্যাজিকের পোষা ছাড়িয়া বাহিরে বারান্দায় দাঁড়াইয়া গোপনে তামাক খাইতেছিল। ভিতরে আসিয়া অবস্থা দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মামা, কি হয়েছে?” রামরতন চিঠিখানি ভাগিনেয়কে পড়িতে দিলেন। ঢিবব্বীর আলোকে ধরিয়া চিঠি পড়িয়া কুলদা বলিল, “কি করবেন;" আজিকার টিকিট বিক্রয়ের টাকা লইয়া, তহবিলে মোটে ত্রিশট টাকা আছে। এখানকার দেনা

পাওনা মিটাইতেই তাহা প্রায় শেষ হইয়া যাইবে; চারিজনের রাহাখরচ কুলাইবে না। রামরতন বলিলেন, “কাল সকালে উঠেই পোষ্ট আপিষে গিয়ে ২৫ টাকা টেলিগ্রাফ মানি অর্ডারে পাঠিয়ে দাও।” কুলদা বলিল, “পাঠাতেও পাঁচসিকে খরচ। তার পর উপায়?” রামরতন উদ্বুদিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ ।৷  "মাতুলের মাথা খারাপ"।

পরদিন বেলা ১টার সময় কুলদা টাকা টেলিগ্রাফ করিয়া পোষ্ট অফিস হইতে ফিরিয়া দেখিল, মাতুল তক্তপোষে বসিয়া একমনে কি লিখিতেছেন। কাছে গিয়া দেখিল, অদ্যকার বিজ্ঞাপনের জন্য হ্যান্ডবিল রচনার তিনি ব্যস্ত। লেখা শেষ হইলে কাগজগুলি ভাগিনেয়কে দিয়া রামরতন কহিলেন, “ছাপাখানায় যাও। - তুমি বসে থেকে কম্পোজ করিয়ে, দু'হাজার ছাপতে অর্ডার দিয়ে এস। যেন দুটোর মধ্যে পাই।” কুলৰ্দা কাগজখানি পড়িতে পড়িতে বলিল, “কিন্তু আজ তাদের গোটা দশেক টাকা দেবো বলে রেখেছিলাম যে, ছাপতে আবার গোলমাল না করে।” রামরতন বলিলেন, “তাদের বোলো কাল সকালে তাদের সমস্ত বাকী টাকা চুকিয়ে দোবো, পাইপয়সা বাকী রাখব না।"

কুলদা পুনরায় হ্যান্ডবিলের খসড়াখানির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, “এটা লিখে ত দিলেন, কিন্তু–কি রকম হবে কিছু যে বুঝতে পারছিনে। শেষকালে একটা ধাষ্টমো না হয়।” রামরতন রাগিয়া বলিলেন, “তু-তু তুমি ছাপিয়েই আন না। কি রকম হবে না হবে সে তখন জানতে পারবে। যাও, দেরী কোর না।" কুলদা চিন্তিত মুখে প্রস্থান করিল। তাহার চিন্তার কারণ এই যে, হ্যান্ডবিলে অদ্য শেষতম—নিতান্তই শেষতম রজনীতে যে নূতন ম্যাজিক দেখাইবার কথা ঘোষণা করা হইতেছে, তাহা শুধু দর্শকমণ্ডলীর নাহ কুলদার পর্যন্ত অশ্রুতপূর্ধ্ব। মাতুল এ ম্যাজিক এতাবৎকাল কোথাও দেখান নাই; এমন কি তিনি প্রসঙ্গক্রমেও কখনও এ ম্যাজিকের উল্লেখ করেন নাই। 

অপর কোনও ম্যাজিকওয়ালা যে ইহা দেখাইতে পারে তাহা পর্যন্ত কস্মিনকালেও শুনে নাই। সে ভাবিতে লাগিল, মাতুল এরুপ বিজ্ঞাপন কেন দিতেছেন? গতকল্য সারারাত্রি তিনি ঘুমান নাই। খালি ছটফট করিয়াছেন এবং মাঝে মাঝে উঠিয়া আলো জ্বালিয়া তামাক খাইয়াছেন। দুশ্চিন্তায় তাঁহার মাথা খারাপ হইয়া গেল নাকি, কুলদা কিছুই বুঝিতে পারিল না। এইরূপ বিজ্ঞাপন দিয়া লোক জড় করিয়া, শেষে ফাঁকি দিলে অদৃষ্টে কি আছে বলা যায় না। রঙ্গপুরের ছাত্রগণ যেরূপ দুর্দান্ত, প্রহার পর্যন্ত করিতে পারে।যাহা হউক, মাতুলের হুকুম কুলদা তামিল করতে গেল। প্রেসের ম্যানেজারবাবু তখনও আসেন নাই। কম্পোজিটরগণ বিজ্ঞাপনের কপি পড়িয়া কুলদাকে আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইল এবং জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “হ্যাঁ মশায়, এ কি সত্যি?”

কুলদা গম্ভীরভাবে বলিল, “সত্যি অবশ্য নয়, ইন্দ্রজাল।” 

“সে আপনাদের ইন্দ্রজালেই হোক চন্দ্ৰজাল হোক—এতে যা সব লেখা আছে, আমরা তা চোখে দেখতে পাব ত?” “তবে মশায়, আজকে আমাদের পাস দিতে হচ্ছে। আমরা তিনজন কম্পোজিটর, জমাদার, “নিশ্চয় পাবেন।” আর ম্যানজারবাবুও যেতে চাইবেন নিশ্চয়—এই পাঁচজনের পাস লিখে দিয়ে যান।” ‘‘তা দিচ্ছি। কিন্তু হ্যান্ডবিলগুল দুটোর মধ্যে চাই।” “দুটো কি বলছেন!—একটার মধ্যেই ছাপা হ্যান্ডবিল আপনাদের বাসায় আমরা পৌঁছে দেবো। 

পাসখানা লিখুন।" শেষ রজনী—শেষ রজনী অদ্য নিতান্তই শেষ রজনী বিপরীত ব্যাপার—লোমহর্ষণ কাণ্ড। অদ্য সৰ্ব্বজন সমক্ষে, প্রোফেসর বসু একটা জীবন্ত মানুষ ধরিয়া ভক্ষণ করিবেন আবার ইন্দ্রজাল প্রভাবে সর্ব্ব-জনসমক্ষে তাহাকে পুনরুজ্জীবিত করিয়া দিবেন।—ইত্যাদি আহারাদি করিয়া, কুলদা বিজ্ঞাপন লইয়া গাড়ীতে বাহির হইল। রামরতন বাজনাওয়ালাদের বলিয়া দিলেন, “আজ তোরা খুব জোরে জোরে বাজাবি। কাল আমরা চলে যাব তোদের ভাল করে বখশিষ দিয়ে যাব।” বেলা ২টা হইতে বিকাল ৫টা অবধি সহরময় বিজ্ঞাপনটি রাশি রাশি বিতরিত হইল। ইহা পাঠ করিয়া সহরময় একটা হৈ হৈ ব্যাপার পড়িয়া গেল। অন্য দিনের ন্যায় অদ্য ও সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় খেলা আরম্ভ। কিন্তু ছ'টার সময় রামরতন বাসায় বসিয়া সংবাদ পাইলেন, টাউন হলের মাঠে ইতিমধ্যেই লোক জমিতে শুরু হইয়াছে। ভাগিনেয়কে বলিলেন, “ঠাকুরকে বল, চট্‌পট্ তৈরী হয়ে নিক। রান্না যদি কিছু বাকী থাকে, নামিয়ে রাখুক, ফিরে এসে তখন হবে।”

খেলার সময় টিকিট বিক্রয়ের ভার এই রায়ণ ঠাকুরের উপর। হরিদাস ও কুলদা গেটে বসিয়া থাকে, টিকিট লইয়া শ্রেণী অনুসারে দর্শকগণকে স্থান নির্দেশ করিয়া দেয়। রামরতন হরিদাসকে বলিলেন, "আমাদের ফাষ্টো কেলাস দু'টাকার টিকিট এক সারি চেয়ার ত?” 

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

 “আর এক টাকার সেকেন কেলাস তিন সারি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।” 

 আচ্ছা দড়ি খুলে, এই চার সারিছ আজ ফাটো কেলাস বানিয়ে দিও। বাকী আর্শেকে সেকেন কেলাস, থার্ডো কেলাস, ফোথো কেলাস ও কেলাসে দু' তিন সারি বেশি রেখ মাত্র।" কুলদা বলিল, "ভাতে চার আনার টিকিট বড্ড কমে যাবে যে।” বামরতন বলিলেন, "তা যাক। গুণতি মতন টিকিট নিয়ে বসবে। এক বেলাসের টিকিট ফুরিয়ে গেলেই, তার উঁচু কেলাসের টিকিট বেচবে।"

তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হইয়া, জিনিষপত্র ও লোকজন সহ রামরতন রওয়ানা হইলেন। টাউন হলে পৌছিয়া দেখলেন, প্রাপ্ত সংবাদ মিথ্যা নহে,-মাঠে বিস্তর লোক টিকিটের জন্য অপেক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। বামুন ঠাকুর দ্বারের কাছে গিয়া টিকিট বিক্রয় করিতে বসিল। কুলদা ও হরিবাস গেটে বসিল। রামরতন ষ্টেজের উপর পর্দার আড়ালে ম্যাজিকের সরগ্রামগুলি শুছাইতে প্রবৃত্ত হইলেন।

 চতুর্থ পরিচ্ছেদ। "মনুষ্য-ভোজন"।

সাড়ে সাতটার সময় পর্দা উঠিলে রামরতন দেখিলেন, হল একেবারে ঝাণায় কাণায় পূর্ণ; প্রথম শ্রেণীর দুই টাকা মূল্যের সমস্ত চেয়ার বিক্রয় হইয়া গিয়াছে; স্বয়ং পুলিশ সাহেব সস্ত্রীক প্রথম সারির মধ্যসস্থলে উপবিষ্ট। অপরাপর শ্রেণীর সমস্ত আসনই পূর্ণ—উভয় পার্শ্বের দেওয়ালের নিকট বিস্তর লোক দণ্ডায়মান। ষ্টেজ হইতেই রামরতন ঝুঁকিয়া, পুলিশ সাহেব ও তদীয় মেমকে ভক্তিভরে সেলাম করিলেন।

খেলা আরম্ভ হইল। প্রথমে তাসের কৌতুক। ষ্টেজ হইতে নামিয়া, প্রথম সারির দর্শকগুণের সমক্ষে ঘুরিয়া ঘুরিয়া রামরতন তাসক্রীড়া দেখাইতে লাগিলেন। তাহার পর ভৌতিক ফুলগাছ জন্মানো, দর্শকের ঘড়ি লইয়া চূর্ণীকরণ এবং অবশেষে তাহা অক্ষত অবস্থায় প্রত্যর্পণ, ছড়ির মধ্যে অঙ্গুরীয় প্রবেশ, কুলদাচরণকে হিপটাইজ করিয়া এবং তাহার চোখ বাঁধিয়া তাহার কর্তৃক দর্শকলিখিত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান ইত্যাদি মামুলি খেলাগুলি শেষ হইতে প্রায় ৯টা বাজিল। অবশেষে রামরতন বলিলেন

ভদ্র মহোদয়গণ, এবার আমি একটা নূতন খেলা আপনাদিগকে প্রদর্শন করিব—সেটি জীবন্ত মনুষ্য-ভক্ষণ। ইহা অত্যন্ত আশ্চর্য্য ব্যাপার। ঔরঙ্গাজের বাদশাহের আমলে জনৈক মুলমান ফকির কর্তৃক ইহা প্রথম প্রদর্শিত হয়। এই অত্যদ্ভুত ক্রীড়াট ভারতীয় প্রতিভারই অক্ষয় প্তি। পাশ্চাত্ত্য যাদুকরগণ ইহা অবগত নহে—ইহা সম্পূর্ণ ভারতীয়। আমি বহু সাধনায় গুরুর নিকট ইহা শিক্ষা করিয়াছি। একটি মনুষ্যকে আপনাদের সমক্ষে ক্রমে ক্রমে আমি সম্পূর্ণ রূপে ভক্ষণ করিয়া ফেলিব এবং অবশেষে উহাকে অক্ষত দেহে আপনাদের নিকট উপস্থিত করিব। দর্শকগণের মধ্যে কে ভক্ষিত হইতে ইচ্ছা করেন, অনুগ্রহ করিয়া এখানে আসুন।"

রামরতন দর্শকমণ্ডলীর উপর তাহার সম্প্রতীক্ষ দৃষ্টি স্থাপন করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। সভামধ্যে হইতে একটা গুঞ্জনধ্বনি উত্থিত হইল। এক মিনিট গেল, দুই মিনিট গেল, তিন মিনিট গেল, কিন্তু ভক্ষিত হইবার জন্য কেহ অগ্রসর হইল না। রামরতন তখন বলিলেন-"মহাশয়গণ, আপনারা কি ভয় পাইতেছেন। ভয়ের কোনও কারণ নেই। 

আমি মনুষ্যটিকে আহার করিয়া, আবার তাহাকে বাঁচাইয়া দিব। আপনারা তখন সকলেই দেখিবেন, তাহার দেহে কোনও আঘাতের চিহ্নমাত্রও নাই। কে আসিবেন, আসুন।” রামরতন পূর্ণ দুই মিনিট কাল অপেক্ষা করিলেন। সভাস্থলে বহুলোকের চাপা গলায় কথা ও চাপা হাসির শব্দ শুত হইল। কিন্তু কেহই খাদিত হইতে আগ্রহ দেখাইল না।

অবশেষে রামরতন বলিলেন, "আপনারা কি ভয় করিতেছেন যে পাছে আমি তাহাকে বাঁচাইয়া দিতে সমর্থ না হই? সে আশঙ্কা করিবেন না মহাশয়গণ, ইহা নির্দোষ আমোদ মাত্র। আমি যদি খাইয়া আবার বাঁচাইয়া দিতে না পারি, তাহা হইলে তা আমি খুনী-খুনের দায়ে পড়িব স্বেয়ং ধর্মাবতার পুলিশ সাহেব বাহাদুর, পুলিশের বড় ইনস্পেক্টরবাবু, স্থানীয় হাকিমগণের মধ্যে অনেকেই আজ দয়া করিয়া এখানে পদধূলি দিয়াছেন দেখিতেছি; যদি আমি মানুষটিকে আবার বাঁচাইয়া দিতে না পারি, তবে ইঁহারা আমাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া ফাঁসি দিবেন সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহা ঘটিবে না। কোনও ভয় নাই কে আসিবেন আসুন।”

তৃতীয় শ্রেণীর একখানি বেঞ্চিতে কয়েকজন ছাত্র বসিয়া গোলমাল ও হাসিতামাসা করিতেছিল; তাহারা ঠেলিয়া এক বালককে উঠাইয়া দিল। সে উঠিয়া স্টেজের দিকে অগ্রসর হইবামাত্র, সমস্ত দর্শক তাহার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল।

বালক ব্রুমে ষ্টেজের পাদদেশে গিয়া দণ্ডায়মান হইল। রামরতন বলিলেন, “উঠে এস বাবা, উঠে এস। কোনও ভয় নেই তোমার।” বালকের বয়স পঞ্চদশ কিংবা ষোড়শ বর্ষ মাত্র। রঙ্গপুর টেকনিক্যাল স্কুলে পড়ে, সাহসী বলিয়া সহপাঠী মহলে তাহার খ্যাতি আছে। কিন্তু ষ্টেজের উপর উঠিতে তাহার পা দুটি কাপিতে লাগিল।

রামরতন বালককে তাহার গাত্রবস্ত্র খুলিয়া ফেলিতে বলিলেন, দেহের উর্ধ্বভাগ নগ্ন করিয়া এক বালক দাঁড়াইল। ভয়ে তাহার বুকটি দুর দুর করিতেছে, মুখখানি ম্লান হইয়া গিয়াছে।

রামরতন দর্শকগণের প্রতি চাহিয়া বলিলেন—“দেখুন ভদ্রমহোদয়গণ, আমি এই বালককে ভক্ষণ করি।”—বালকের দিকে চাহিয়া মাথা হেলাইয়া বলিতে লাগিলেন—“বাঃ বাঃ-খাসা নধর দেহ। অনেক দিন মানুষ খাইনি, কচি মাংস বেশ লাগবে খেতে।”—বলিয়া জিহ্বা বাহির করিয়া, তদ্দ্বারা নিজ ওষ্ঠযুগল সিক্ত করিতে লাগিলেন।


হলভরা সমস্ত লোক একেবারে নিস্তব্ধ। একটি সূচ পড়িলে তাহার শব্দটুকু শুনা যায়। বালকের একবার ইচ্ছা হইল, সরিয়া পড়ে—কিন্তু লোকলজ্জায় সে তাহা করিতে পারিল না। উভয় চক্ষু মুদ্রিত করিয়া, কোনমতে খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।


রামরতন সহসা বালকের স্কন্ধোপরি সজোরে এক কামড় বসাইয়া দিলেন। “বাপরে মারে উহুহু"-বালকের এই আর্দ্র চীৎকারে সেই গভীর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হইল। দর্শকগণের মধ্যে কয়েকজন দাঁড়াইয়া উঠিয়া ক্রুদ্ধস্বরে বলিল, “ওকি মশায় ওকে কামড়ালেন কেন?" রামরতন বলিলেন, “কামড়াব না ত খায় কি করে মশায়। অত বড় মানুষটা ত গপ্ করে

গিলে খেতে পারিনে, একটু একটু করে আমায় খেতে হবে ত! সমস্তটা খাব, খেয়ে ইন্দ্রজালের জোরে আবার বাঁচিয়ে দেব।” ইহা শ্রবণমাত্র, বালক ষ্টেজ হইতে এক লম্ফ দিয়া খোলা দরজায় দণ্ডায়মান প্রহরীকে ঠেলিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। 

হলের ভিতর তখন মহা গণ্ডগোল আরম্ভ হইল। কেহ কেহ উচ্চস্বরে চীৎকার করিতে লাগিল—"এ কি জচ্চুরি নাকি মশায়? ইন্দ্রজালের প্রভাবে যাবেন ত কামড় দিলেন কেন? সব বুঝি ফাঁকি?” রামরতন দেখিলেন, হলের অধিকাংশ লোকই অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে, কেবল


পুলিশ সাহেব ও তাঁহার মেম মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। রামরতন কহিলেন, "কেন মশায়, ফাঁকিটা আমি কি দিলাম? বিজ্ঞাপন পড়ে দেখুন, ইন্দ্রজাল প্রভাবে খাব বলিনি, ইন্দ্রজাল প্রভাবে বাঁচিয়ে

দেবো বলেছি। আগে খাই, তবে ত বাঁচার। যার ইচ্ছে হয় আসুন না বিজ্ঞাপনে যে খেলা দেখার বলেছি তাই দেখাচ্ছি।" দর্শকগণ উত্তেজিত স্বরে বলিতে লাগিল, “থাক থাক ঢের হয়েছে, আর খেলা দেখাতে হবে না। আমরা তোমায় কি রকম খেলা দেখাই তা দেখ। হল থেকে বেরোও দিকিন একবার জোচ্চর  কহেকা

রামরতন ক্রন্দনের মত স্বরে বলিয়া উঠিলেন, “অ্যাঁ-অ্যাঁ তোমরা আমায় মারবে নাকি? কেন, আমি কি দোষ করেছি? (যোড়হস্তে পুলিশ সাহেবের পানে চাহিয়া) দোহাই গবর্ণমেন্টের, দোহাই ইংরেজ বাহাদুরের—আমি নিদোষী। তোমরা আমরা হ্যান্ডবিল পড়ে দেখ, আমি কি চুরি করেছি?” পুলিশ সাহেব তাঁহার মেমকে হাসিতে হাসিতে কি বলিতেছিলেন, রামরতনের ক্রন্দন ও

দোহাই শুনিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “এ বুঢ়া টুমি ভয় করিও না। কেহ টোমায় মারিটে পারিবে না। (পশ্চাৎ ফিরিয়া) বাবুলোগ, টোমরা সব চুপচাপ আপন আপন গৃহে গমন কর।

বে-আইন জনটা করিলে গ্রেফটার হইবে।" অতঃপর দর্শকগণ গজগজ করিতে উঠিয়া বাহির হইতে লাগিল। পুলিশ সাহেব চুরুট মুখে করিয়া তথায় নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

হল খালি হইয়া গেলে, রামরতন ষ্টেজ হইতে নামিয়া পুলিশ সাহেব ও তাঁর মেমকে দুই দীর্ঘ সেলাম করিয়া, করযোড়ে বলিলেন, “আজ হুজুর ছিলেন বলেই অধীনের প্রাণ বাঁচলো। আমাকে বাড়ী পৌঁছে দেবার জন্যে যদি দয়া করে দুজন কনস্টেবল হুকুম করে দেন তবে ভাল হয়; কি জানি রাস্তায় যদি " পুলিশ সাহেব রামরতনের স্কন্ধে মৃদু মৃদু করাঘাত করিয়া হাসিতে হাসিতে কহিলেন— “টুমি বড় শয়তান আছ - A downright scoundrel! পুলিশের উপযুক্ত লোক। টোমার বয়স কম হইলে, আমি টোমায় পুলিশে ভারোগা কাৰ্য্য দিট। এখন গৃহে যাও—কল্য প্ৰাটেই টুমি রঙ্গপুর পরিট্যাগ করিয়া যাইবে।"-মেমসাহেবও হাসিতেছিলেন।

পুলিশ সাহেবের হুকুম অনুসারে তথায় উপস্থি দুইজন কনেস্টেবল রামরতনকে বাসায় পৌঁছাইয়া দিল।পরদিন পাওনাদারগণের প্রাপ্য নিঃশেষে চুকাইয়া দিয়া, বাকী টাকার রাশি পুটলি বাঁধিয়া লইয়া রামরতন রঙ্গপুরের মায়া পরিত্যাগ করলেন। গৃহে পৌছিয়া দেখিলেন, ঈশ্বরকৃপায় মেয়েটির পীড়ার অনেকটা উপশম হইয়াছে। 

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। 'বাজীকর' গল্পটি কোন পত্রিকার কোন সংখ্যায় প্রকাশিত? 

উত্তর। ‘বাজীকর' গল্পটি 'মানসী' পত্রিকার পৌষ, ১৩২৪ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত। 

প্রশ্ন ২। 'বাজীকর' গল্পে ক'টি পরিচ্ছেদ? পরিচ্ছেদগুলির নাম কী?

উত্তর। 'বাজীকর’ গল্পে চারটি পরিচ্ছেদ।

 পরিচ্ছেদগুলির নাম: 

  • প্রথমঃ ‘ভগবান আর কষ্টদিও না',
  • দ্বিতীয়ঃ 'ছেলেগুলো ভারি জ্যাঠা হইয়াছে',
  • তৃতীয়ঃ ‘মাতুলের মাথা খারাপ', এবং 
  • চতুর্থঃ 'মনুষ্য ভোজন'।

প্রশ্ন ৩। 'বাজীকর' গল্পের বাজীকর কে? তার বয়স কত?

উত্তর। 'বাজীকর' গল্পের বাজীকর হলেন শ্রীরামরতন বসু। তিনি প্রফেসর বসু নামেও পরিচিত। তাঁর বয়স ষাট বছরের কম নয়।

প্রশ্ন ৪। বাজীকরের বাড়ি কোন জেলায়? তিনি বাজী দেখাবার জন্য ঘর ভাড়া নেন কোন শহরে?

উত্তর। বাজীকরের বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। তিনি বাজী দেখাবার জন্য ঘর নিয়েছিলেন রংপুর জেলার রংপুরে।

প্রশ্ন ৫। বাজী দেখাবার সময় রামরতন বাবুর সহায়কের কাজ করেন কে?

উত্তর। বাজী দেখাবার সময় রামরতন বাবুর সহায়কের কাজ করেন ভাগিনেয় কুলদাচরণ। 

প্রশ্ন ৬। কুলদাচরণ প্রফেসর বোসের কে? সে কী কী কাজ করে?

উত্তর। কুলদাচরণ প্রফেসর বোসের ভাগিনেয়। সে বাজী দেখাবার সময়ে প্রফেসর বোসকে সহায়তা করে। প্রতিদিন ২-টা থেকে ৫-টা গাড়ি ভাড়া করে শহরময় ‘আদ্যকার অত্যাশ্চর্য ম্যাজিক খেলার বিজ্ঞাপন বিলি করে বেড়ায়। অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজও সে সামলায়।

 প্রশ্ন ৭। রামরতনবাবুর বাড়িতে কে কে থাকেন?

উত্তর। রামরতন বাবুর বাড়িতে আছেন দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী এবং বিবাহযোগ্যা দুই কন্যা।

প্রশ্ন ৮। রামরতনবাবুর কন্যারা বিবাহযোগ্যা হলেও তাদের বিবাহ দেননি কেন?

 উত্তর। রামরতনবাবুর কন্যারা বিবাহযোগ্যা হলেও বিবাহ দেওয়া যায়নি অর্থাভাবে। প্রফেসর বোস বাজী দেখিয়ে তেমন কিছু আয় ও সঞ্জয় করতে পারেন নি। 

প্রশ্ন ৯। রামরতনবাবু কখন কীভাবে ম্যাজিক শিখেছেন?

উত্তর। রামরতন বাবু যৌবনে বাড়ি থেকে পালিয়ে ভুরে খাঁ ও চাঁদ খাঁ নামের দুই ম্যাজিসিয়ান ভ্রাতার সাগরেদি করে ম্যাজিক শিখেছেন। 

প্রশ্ন ১০। রামরতনবাবু দরিদ্র হয়ে গেলেন কীভাবে?

উত্তর। রামরতনবাবুর পৈতৃক সম্পত্তি, জোৎ- জমি কিছু ছিল। তাতেই সংসার চলত। কিন্তু প্রথম পক্ষের স্ত্রী তিন কন্যা উপহার দেন; তাদের বিবাহ দিতেই সব শেষ হয়ে ঋণ হয়ে যায়। তিনি গরীব হয়ে যান। তাই ম্যাজিককে পেশা করেন।

প্রশ্ন ১১। এখন আর কেউ টিকিট কেটে ম্যাজিক আসে না কেন?

উত্তর। ম্যাজিক খেলায়, নতুনত্ব কিছু নেই; থিয়েটার বা সার্কাসে আছে। তাছাড়া প্রদর্শনীতে সুন্দরী মেয়েদের উপস্থিতি দর্শকরা চায়; রামরতনের দলে মেয়ে ছিল না। বৃদ্ধ রামরতনের বক্তৃতা আর বুজরুকি শোনার জন্য আর কারো আগ্রহ ছিল না।

প্রশ্ন ১২। রঙ্গপুর শহরে কটা স্কুল? স্কুলগুলিতে ম্যাজিক দেখার বিজ্ঞাপন দিতে গিয়ে কত ছৈলের মধ্যে কত টিকিট বিক্রি হয়?

উত্তর। রঙ্গপুর শহরে তিনটি স্কুল, – জেলা স্কুল, টাউন স্কুল ও কৈলাসরঞ্জন স্কুল। তিনটে স্কুলে প্রায় বারোশো ছেলে। টিকিট বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫২-টি। হাপ প্রাইসে আপত্তি নেই।”― কে, কোন

প্রশ্ন ১৩। “যদি বেশি ছেলে আসে ত ছেলেদের কোথায় আসার কথা বলেছে?

উত্তর। বাজীকর রামরতন বসু রঙ্গপুরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের বাজী বা ম্যাজিক দেখতে আসার কথা বলেছেন।

প্রশ্ন ১৪। ‘বাজীকর’ গল্পের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের নাম কী? কেন এমন নামকরণ হয়েছে? 

উত্তর। ‘বাজীকর’ গল্পের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের নাম 'ছেলেগুলো ভারি জ্যাঠা হইয়াছে।' স্কুলের ছেলেরা এখন বাজী দেখতে আসে না। বিরূপ মন্তব্য করে। সেই জন্যেই রামরতন বাবুর কথা অনুসারে পরিচ্ছেদের এমন নামকরণ হয়েছে।

প্রশ্ন ১৫। স্ত্রী কী উপলক্ষে রামরতনের কাছে কত টাকা চেয়ে পাঠিয়েছিল?

উত্তর। রামরতনের স্ত্রী ছোট মেয়ের জ্বর-বিকারের দুঃসংবাদ জানিয়ে স্বামীর কাছ থেকে অন্তত ২৫ টাকা চেয়ে পাঠায় চিকিৎসাও পথ্যের জন্য।

প্রশ্ন ১৬। শেষ রজনীর ম্যাজিকের প্রধান খেলাটা কী ছিল? 

উত্তর। শেষ রজনীর ম্যাজিকের প্রধান খেলাটা ছিল প্রফেসর বোস কর্তৃক জীবন্ত মনুষ্য ভক্ষণ।

প্রশ্ন ১৭। শেষ রজনীর অশ্রুত পূর্ব ম্যাজিক দেখবার জন্য বিশিষ্টজনদের মধ্যে কে কে উপস্থিত ছিলেন?

উত্তর। শেষ রজনীর ম্যাজিক প্রদর্শনীতে বিশিষ্টজনদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং পুলিশ সুপার এবং তার স্ত্রী।

প্রশ্ন ১৮। কে কৰে জীবন্ত মনুষ্য ভক্ষণের খেলা দেখিয়েছিল বলে রামরতন জানান? 

উত্তর। অত্যাশ্চর্য খেলা জীবন্ত মনুষ্য ভক্ষণ দেখাবার আগে রামরতন বোস উল্লেখ করেন, ঔরঙ্গজেব বাদশাহের আমলে এক মুসলমান ফকির কর্তৃক এই খেলা প্রথম প্রদর্শিত হয়।

প্রশ্ন ১৯। মনুষ্য ভক্ষণ খেলায় যে ছেলেটি ভক্ষিত হতে আসে তার পরিচয় কী? 

উত্তর। ভক্ষিত হতে আসা রঙ্গপুর টেকনিক্যাল স্কুলের ১৫-১৬ বছরের ছাত্র। বন্ধু মহলে সে সাহসী বলে পরিচিত বলেই তাকে ঠেলে পাঠানো হয়। 

প্রশ্ন ২০। বাজীকর রামরতন কর্তৃক মনুষ্যভক্ষণ ম্যাজিকের পরিণতি কী হয়?

উত্তর। মনুষ্য ভক্ষণ খেলায় যে ছেলেটি ভক্ষিত হতে আসে, বাজীকর রামরতনবাবু তার ঘাড়ে একটা কামড় দিলে এবং কীভাবে একটু একটু করে ছেলেটিকে খাবেন, তা বলতে থাকায় ছেলেটি আসন্ন যন্ত্রণার কথা মনে ক'রে মঞ্চ থেকে পালিয়ে যায়। তাকে আর ধরা যায়নি। তাই মনুষ্য ভক্ষণ খেলাটা আর দেখানো যায়নি।

২১। রামরতনবাবুর মনুষ্যভক্ষণ খোলাটা কি সত্যি ছিল, নাকি টাকা রোজগারেরমরিয়া চেষ্টা বা উপায় ছিল? 

উত্তর। বাজীকরের কোনো খেলাই সত্যি নয়, মানুষের চোখকে ফাকি দেওয়া। তবে অন্য খেলাগুলো দেখানো গিয়েছে; মনুষ্য ভক্ষণ দেখানো যায়নি। বাজীকর রামরতন বাবুর হাজার খানেক টাকার খুব দরকার ছিল। টাকা উপার্জনের অন্য কোনো উপায় জানা না থাকায় মনুষ্য ভক্ষণের অদ্ভুত খেলা দেখার পরিকল্পনা করেন। তিনি জানতেন, খেলাটা দেখার জন্য প্রচুর মানুষ আসবেন, কিন্তু কেউ কামড় খেতে চাইবেন না। তাই খেলাটা দেখাতে হবে না।

প্রশ্ন ২২। “বে-আইন জনটা করিলে গ্রেটার হইবে।”—কে কাকে একথা বলেছেন? ‘বে-আইন জনটা' করেছে কারা?

উত্তর। ‘‘বে-আইন জনটা করিলে...”—একথা বলেছেন ম্যাজিক দেখতে আসা পুলিশ সুপার–অন্য দর্শকদের উদ্দেশ্য করে। রামরতন মনুষ্য-ভক্ষণ খেলাটা ম্যাজিকের মতো নির্ঝঞ্ঝাটে দেখাতে না পারায় আশাহত দর্শকগণ মারমুখী হয়ে উঠলে তাদের শান্ত করতে একথা বলেছেন।

প্রশ্ন ২৩। “টুমি বড় শয়তান আছ – ” কে কাকে বলেছে? কেন? 

উত্তর। “টুমি বড় শয়তান আছ"—কথাটা ম্যাজিক দেখতে আসা পুলিসসুপার বলেছেন বাজীকর রামরতনকে। কারণ, তিনি জেনে শুনেই, বিশেষ কায়দায় বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষ খাওয়ার খেলা দেখাতে চান। কারো শরীর কামড়ে কামড়ে খেতে চাই কেউ ভক্ষিত হ’তে রাজি হবে না; খেলাও দেখাতে হবে না। এই ধুরন্ধর পরিকল্পনার জন্যই পুলিশ সুপার একথা বলেছেন।

প্রশ্ন ২৪। রামরতনের বয়স কম হলে পুলিশ সুপার তাঁকে কী দিতে পারতেন? 

উত্তর। রামরতনের বয়স কম হলে পুলিশ সুপার তাঁকে পুলিশের চাকরি দিতে পারতেন। 

প্রশ্ন-২৫। ম্যাজিক দেখানোর হ'ল ছেড়ে যাওয়ার আগে পুলিশ সুপার রামরতনকে কী আদেশ দিয়ে যান? রামরতন সে আদেশ মেনেছিলেন কি?

উত্তর। হল ছেড়ে যাবার সময় পুলিশ সুপার রামরতনকে আদেশ করেন, আগামীকাল প্রাতেই যেন তিনি রঙ্গপুর পরিত্যাগ করেন। রামরতন আত্মরক্ষার জন্যই সে আদেশ পালন করেন।

সংক্ষিপ্ত রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। “বাজীকর’ গল্পের বাজীকর কে? তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তর। 'বাজীকর' গল্পের বাজীকর হ'লেন শ্রী রামরতন বসু, যিনি প্রফেসর বোস নামেও পরিচিত। বয়স ষাটের উপর। শরীরে বার্ধক্যের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। চুল ও গোঁফ বিলকুল পাকা। লাঠি ধরে একটু কুঁজো হয়ে হাঁটেন। গায়ের রং এক কালে ভালো ছিল, এখন মলিন হয়েছে। স্থানে স্থানে মেজেতা পড়েছে। চোখ দুটো বড়ো বড়ো। তবে ঘোলাটে হয়ে এসেছে।

রামরতন যৌবনে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ভুরে খাঁ আর চাঁদ খাঁ নামে দুই ম্যাজিসিয়ান ভ্রাতার সাকরেদি করে ম্যাজিক শিখেছিলেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে ম্যাজিক দেখাতেন না। পৈতৃক বিষয়-সম্পত্তি যা ছিল তাই দিয়েই সংসার চলে যেত। তিনটি কন্যা বড়ো হলে তাদের বিবাহ দিতে সেই বিষয় সম্পত্তি শেষ হয়ে যায়। প্রথম পক্ষ মারা গেলে পুনর্বিবাহ করেন। দ্বিতীয় পত্নীও তাঁকে দু'টি কন্যা উপহার দেয়। তাদেরও এখন বিবাহের বয়স উত্তীর্ণ হয়েছে। উপার্জনের জন্য স্ত্রীর গহনা বেচে ম্যাজিকের সাজ-সরঞ্জাম কিনে এনে ম্যাজিক দেখানো শুরু করেন। প্রথম প্রথম ভালোই উপার্জন হত।

 তিন-চার মাসের উপার্জেনেই সারা বছর চলে যেত। কিন্তু এখন মানুষ আর ম্যাজিক দেখতে চায় না। উপার্জনও তেমন হয় না। মেয়ে দুটোর বিবাহ না দিলেই নয়। কী উপায়ে যে বিবাহের টাকা সংগ্রহ করবেন এটাই হয়েছে এখন। রামরতন বাবুর সর্বক্ষণের ভাবনা। 

প্রশ্ন ২। 'বাজীকর' গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদের নাম কী? পরিচ্ছেদের বিষয় আলোচনা করে এই নামকরণের সার্থকতা নির্দেশ করো?

উত্তর। ‘বাজীকর’ গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদের নাম বা বিষয় হ’ল ‘ভগবান আর কষ্ট দিও না। গল্পের নায়ক বাজীকর রামরতন বসু এখন বৃদ্ধ; ষাটের উপর বয়স। দেহে বার্ধক্যের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। এখন তাঁর বিশ্রাম দরকার। কিন্তু, বিশ্রাম তাঁর ভাগ্যে নেই। যৌবনে কাজে মন না-দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। 

বাড়ি থেকে পালিয়ে ভুরে খাঁ আর চাঁদ খাঁ নামে দুই ম্যাজিসিয়ান ভাতার সাকরেদি ক'রে ম্যাজিক শিখেছেন। কিন্তু প্রথম দিকে ম্যাজিক দেখিয়েও রোজগার করেননি। পৈতৃক বিষয়-আসয় কিন্তু ছিল, তার উপর নির্ভর করেই সংসার চালিয়েছেন। সংসারও ছোটো রাখেন নি। প্রথমা স্ত্রী তিন কন্যা রেখে মারা গেলে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। এই দ্বিতীয়া স্ত্রীও দুটি কন্যা উপহার দেয়।

প্রথম পক্ষের তিন কন্যার বিবাহ দিতে পৈতৃক সম্পত্তি সব বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু ঋণও হয়ে যায়। এখন সংসার চালানো, ঋণ শোধ করা, বাকি দুই কন্যার বিবাহ দেওয়া ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় রামরতনের। উপার্জনের জন্য তিনি স্ত্রীর অলংকার বেচে ম্যাজিকের সরাম কিনে এনে ম্যাজিক দেখানো শুরু করেন।

প্রথম প্রথম ম্যাজিক দেখানো থেকে ভালই উপার্জন হ'ত। পূর্বকৃত ঋণ শোধ করাও সম্ভব হয়। কিন্তু, পরবর্তীকালে ম্যাজিক দেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেল। উপার্জন কমে গেল। একটা পয়সাও সঞ্জয় হয় না। মেয়ে দু'টোর বিবাহ না দিলেই নয়। উপার্জনের আর কোনো পথ জানা না থাকায় রামরতন মানসিক দিক থেকে চিন্তা জর্জরিত হতে থাকেন। 

একা থাকলেই কোনো গভীর ভাবনায় ডুবে থাকেন। মনে মনে কষ্ট পান। আর মনে মনেই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন, 'হে ভগবান। আর কষ্ট দিও না।'—পরিচ্ছেদের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই পরিচ্ছেদের নামকরণ হয়েছে। তাই, এ নামকরণ সার্থক বলেই মনে করি।

প্রশ্ন ৩। “ছেলেগুলো ডারি জ্যাঠা হইয়াছে”— এই শিরোনাম কোন্ পরিচ্ছেদের?এমন শিরোনামের কারণ আলোচনা করো?

 উত্তর। “ছেলেগুলো ভারি জ্যাঠা হইয়াছে"— এই শিরোনাম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের। বাজীকর গল্পের নায়ক রামরতন বসু প্রৌঢ় বয়সে সংসার চালাবার রসদ সংগ্রহ করতে যৌবনে

ঘর-পালিয়ে শেখা ম্যাজিককে আশ্রয় করেন। প্রথম প্রথম ম্যাজিক দেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল। রোজগার ভালোই হত। তিন-চার মাস ম্যাজিকে দেখিয়েই সারাবছরের জন্য সংসার খরচ সংগৃহীত হত। কিন্তু পরের দিকে ম্যাজিক আগ্রহ কমতে লাগল। স্কুলের ছেলেরা আগে দল বেঁধে আসতো; অনেক টিকিট বিক্রি হত। এখন স্কুলে গিয়ে প্রচার করলেও তেমন টিকিট বিক্রি হয় না। রংপুর শহরের তিনটি স্কুলে বারো শোর উপর ছাত্র ৫২-টা টিকিট বিক্রি হয়েছে। ছেলেদের ম্যাজিক দেখতে উৎসাহিত করতে গেলে বলে—“ম্যাজিক আর দেখব কি, ও ত আমরাও করতে পারি।” ভাগনে কুলদাচরণের মুখে ছেলেদের সম্পর্কে এই কথা শুনে রামরতন বলেন,

"ছেলেগুলোও সব জ্যাঠা হয়ে উঠলো।” না জেনেও যারা জানার ভাণ করে, তাদেরই ‘জ্যাঠা’ বলা হয়। স্কুলে পড়া ছেলেগুলোর জ্যাঠামির জন্য ম্যাজিকের দর্শক কমছে, রামরতনের

উপার্জনও কমছে। তাঁর দুর্ভাবনার কারণ হয়ে উঠছে। তাঁর এখন অনেকগুলো টাকার প্রয়োজন। ম্যাজিক দেখানো ছাড়া উপার্জনের আর তো রাস্তা নেই! সেই ম্যাজিকও যদি ছেলেরা না দেখে, বা অপরকে দেখতে অনুৎসাহিত করে, তাহলে তো রামরতনের ক্ষতি। তাই তিনি আক্ষেপ করেন।  

রামরতনের দুর্ভাবনা আর আক্ষেপই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের মূল বিষয়; সেজন্যই এমন শিরোনাম দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন ৪। “মাতুলের মাথা খারাপ”-কোন্ পরিচ্ছেদের শিরোনাম? এমন শিরোনাম কতটা সঙ্গতিপূর্ণ? আলোচনা করো?

উত্তর। 'বাজীকর’ গল্পের তৃতীয় পরিচ্ছেদের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে—'মাতুলের মাথা খারাপ'।গল্পের নায়ক রামরতন বাবু হ'লেন কুলদাচরণের মাতুল। মাতুল রামরতন বাবু বর্তমানে খুবই অর্থ সংকটের মধ্যে রয়েছেন। এমনিতেই তাঁর সঞ্চয় বলতে আর কিছুই নেই। টেনে টুনে কোনো রকমে সংসার চলে। সামনের বৈশাখে বড় মেয়েটার বিবাহ না দিলেই নয়। অন্তত, একটি হাজার টাকা দরকার। কিভাবে এতগুলো টাকা সংগ্রহ করা যাবে, এটাই যখন রামরতনের দুর্ভাবনা, তখন স্ত্রীর কাছ থেকে পত্র আসলো, ছোটো মেয়েটা অসুস্থ। জ্বর বিকারের পর্যায়ে যাচ্ছে। ঔষধ-পথ্য-চিকিৎসার অর্থ নেই। পত্র পেয়ে চলে এসো। অন্তত, পঁচিশটা টাকা পাঠাও।

হাতে যা টাকা ছিল সবটা স্ত্রীকে মণিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়ে রামরতন ভাবতে বসলেন, এখানকার দেনা মিটিয়ে কিছু টাকা হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন কী উপায়ে। অনেক ভেবে তিনি একটা বিজ্ঞাপনের খসড়া তৈরি করলেন। ছাপা খানায় গিয়ে দু'হাজার ছাপিয়ে বিলি করতেও নির্দেশ দিলেন। বিজ্ঞাপনটায় চোখ বুলিয়ে ভাগনে কুলদার বিস্ময় এবং সংশয় দুই-ই জাগলো। অদ্য শেষ রজনী, নিতান্তই রজনী। আজকের বিস্ময়কর, অভুতপূর্ব খেলা জীবন্ত মনুষ্য ভক্ষণ। প্রফেসর বোস সকলের সম্মুখেই জীবন্ত মানুষ ভক্ষণ করবেন এবং ইন্দ্রজালের সাহায্যে জীবিত করবেন।

কুলদা বা অন্য কেউ এমন খেলা কখনো দেখেনি। শোনেওনি। যদি এমন খেলা মামার জানা ছিল কেন কোনো দিন বলেন নি। একি সত্যি হতে পারে! কুলদার মনে হয়, ভেবে ভেবে মাতুলের মাথা খারাপ হয়েছে। মনে হয় পাঠকদেরও। এই বিজ্ঞাপনই এই তৃতীয় পরিচ্ছেদের কেন্দ্রীয় বিষয়। সেজন্যই এর শিরোনাম রাখা হয়েছে 'মাতুলের মাথা খারাপ।

প্রশ্ন ৫। “হল ভরা সমস্তলোক একেবারে নিস্তব্ধ। একটি সূচ পড়িলে তাহার শব্দটুকু শুনা যায়।”— কোন হলের কথা বলা হয়েছে? হল এমন নিস্তব্ধ হওয়ার কারণ কী? 

উত্তর। “হল ভরা সমস্তলোক একেবারে নিস্তব্ধ। ..." এখানে রংপুর শহরের টাউন হলের কথা বলা হয়েছে; যে হল ভাড়া নিয়ে বাজীকর রামরতন বসু বাজী বা ম্যাজিক দেখাতেন।হল নিস্তব্ধ থাকার কারণ, যে খেলাটা দেখাবার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল, সেই খেলাটা কেউ আগে কখনো দেখে নি। শোনেও নি। খেলাটা হল, প্রকাশ্যে জীবন্ত মনুষ্য ভক্ষণ। হলে বহু মানুষ থাকা সত্ত্বেও ভক্ষিত হবার ইচ্ছা কারো ছিল না। 

টেকনিক্যাল স্কুলের ছাত্ররা এক সাহসী ছাত্রকে ঠেলে তুলে সে ভয়ে ভয়ে মঞ্চে আসে। তার পা কাঁপতে থাকে। রামরতনের কথা মতো উর্ধাঙ্গের বস্ত্র খুলে, নগ্ন দেহে দর্শকদের সামনে দাঁড়ায়। রামরতন তাকে ভক্ষণ করতে অগ্রসর হন। দর্শকদের উদ্দেশ্যে রামরতন বলেন, “দেখুন ভদ্রমহোদয়গণ, আমি এই বালককে ভক্ষণ করি। খেতে।” বাঃ বাঃ খাসা নধর দেহ। অনেক দিন মানুষ খাইনি, কচি মাংস বেশ লাগবে

—এই সব কথা বলতে বলতে, জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠযুগল সিক্ত করতে করতে রামরতনবাবু যখন ছেলেটার পাশে এসে দাঁড়ান, তখন এক অদ্ভূত, বিস্ময়কর, ভয়ংকর দৃশ্য দেখবার জন্য দর্শকগণ একশো ভাগ মনোযোগী হয়ে হয়ে উঠেছেন। সে জন্যই হলে নিস্তব্ধ ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। সূচ পড়লেও যেন শব্দ শোনা যাবে।

প্রশ্ন ৬। 'বাজীকর' গল্পে মনুষ্য-ভোজনের পরিণতি কেমন হয়? আলোচনা করো। গল্পের শেষ পরিচ্ছেদের নাম কী?

উত্তর। ‘বাজীকর' গল্পের শেষ পরিচ্ছেদের প্রধান বিষয় প্রফেসর বোস কর্তৃক প্রকাশ্যে জীবন্ত মনুষ্য ভক্ষণ। অর্থের প্রয়োজনে রামরতনবাবু এই অত্যাশ্চর্য, অভুতপূর্ব খেলা দেখাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কেউ কখনো দেখে নি, শোনেও নি। তাই হলে প্রচুর দর্শক সমাগমও হয়েছে। সাধারণ কিছু পরিচিত খেলা দেখাবার পর রামরতন বাবু ঘোষণা করেন, এইবার মনুষ্য ভক্ষণ খেলাটি তিনি দেখাবেন।

 দর্শকদের মধ্যে যিনি ভক্ষিত হতে চান, তিনি যেন নির্ভয়ে মঞ্চে উঠে আসেন। বলাই বাহুল্য, কেউই ভক্ষিত হতে চান না। শেষ পর্যন্ত একটি ছেলে আসে। কিন্তু সেও ভয়ে কাঁপতে থাকে। রামরতন বাবু তাকে সাহস যোগালেও সান্ত্বনা দিলেও যখন জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠদ্বয় সিক্ত করে বলেন, “বাঃ বাঃ—খাসা নধর দেহ। 

অনেক দিন মানুষ খাইনি, কচি মাংস বেশ লাগবে খেতে।”— এবং সহসা ছেলেটার স্কন্ধোপরে সজোরে এক কামড় বসিয়ে দেয়, তখন ছেলেটা ‘বাপরে—মারে’ বলে আর্তনাদ করে ওঠে। কয়েকজন দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন, ‘ওকি মশায় ওকে কামড়ালেন কেন?” তখন রামরতন বলেন, “কামড়ার নাত খাব কি করে মশায়? অত বড় মানুষটা ত গপ্ করে গিলে খেতে পারিনে।” একটু একটু করে কামড়ে কামড়ে খাওয়ার কথা শুনে ভয়ে মঞ্চে দাঁড়ানো ছেলেটা লাফ দিয়ে নেমে পালায়। তখন হলের মধ্যে গণ্ডগোল লেগে যায়। তর্কাতর্কি, দর্শকদের গালাগালি, দেখে নেবার হুমকি। ভয় পেয়ে রামরতন পুলিশ সুপারের সাহায্য প্রার্থনা করেন। 

তাঁর উপস্থিতিতে গণ্ডগোল বেশিদূর গড়ায় না। তবে, বাড়ী দেখানোও শেষ করতে হয়।গল্পের শেষ পরিচ্ছেদটির নাম 'মনুষ্য-ভোজন'।


রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। ‘বাজীকর’ গল্পের বিষয়স্তু সংক্ষেপে আলোচনা করো এব ছোটোগল্প হিসেবে সার্থকতা নিরূপণ করো।

উত্তর। ছোটোগল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি বিশিষ্ট ছোটগল্প ‘বাজীকর'। এই গল্পের প্রধান বিষয় বাজীকর রামরতনবাবুর দারিদ্রজনিত দুর্ভাবনা এবং এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তের বাঞ্ছিত পরিণতি। গল্পটির উপস্থাপনা শিল্পসম্মত এবং উপসংহার যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক।

গল্পটির চারটি পরিচ্ছেদ। প্রতিটি পরিচ্ছেদের বিষয় অনুযায়ী শিরোনাম দেওয়া হয়েছে। প্রথম পরিচ্ছেদের নাম 'ভগবান আর কষ্ট দিও না'। এই নাম থেকেই বোঝা যায়, রামরতন অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। যৌবনে উপার্জন ও সঞ্চয়ের কথা ভাবেন নি। ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে ম্যাজিক শিখেছিলেন। কিন্তু ম্যাজিক দেখিয়ে উপার্জনের কথাও ভাবেন নি। পৈতৃক বিষয় থেকেই বেশ চলে যাচ্ছিল। বিবাহ করেন যাকে তিনি তিনটি কন্যা উপহার দিয়ে স্বর্গে গেলেন। সংসার সামলাবার জন্য দ্বিতীয়বার যাকে বিবাহ করলেন, তিনিও দুই কন্যা উপহার দিলেন। পাঁচ কন্যার মানুষ করে বিবাহ দিতে তো টাকার প্রয়োজন হয়।

প্রথম পক্ষের তিনকন্যার বিবাহ দিতে পৈতৃক বিষয় শেষ হয়েও কিছু ঋণ রয়ে যায়। এবার সংসার চালাবার জন্য ও ঋণশোধের জন্য রামরতনবাবু ম্যাজিক দেখানোকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। স্ত্রীর অলংকার বেচে ম্যাজিকের সরঞ্জাম কেনেন। কিন্তু ম্যাজিক থেকে উপার্জন তেমন হয় না। জমে না কিছুই। দুটো মেয়ের বিয়ে যে কীভাবে দেবেন! ভেবে ভেবে কোনো উপায় দেখতে পান না। তাই কষ্ট পান। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন, তিনি যেন আর কষ্ট না দেন।

ম্যাজিকে আয় বাড়াবার অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু কাজ কিছু হয়নি। স্কুলের ছেলেরাই ম্যাজিক দেখে বেশী। কাজের উৎসাহ দিতে প্রদর্শনীতে আসতে প্রচুর বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে প্রচার করা হয় যাতে ছেলেগুলো প্রদর্শনী আসতে পারে! কিন্তু, তাতেও লাভ কিছুই হয় না। এখনকার ছেলেগুলো জ্যাঠা হয়েছে।

এর মধ্যে বাড়ি থেকে স্ত্রীর পত্র এল, ছোটো মেয়েটার ভীষণ জ্বর। অর্থাভাবে চিকিৎসা ও পথ্য হচ্ছে না। পত্র পাঠ অন্তত পঁচিশটা টাকা যেন পাঠানো হয়। আদরের কন্যার অসুখ শুনে রামরতন সব কটি টাকা স্ত্রীর নামে মনিঅর্ডার করতে পাঠিয়ে দিয়ে আবার ভাবতে বসেন। কষ্ট পেতে থাকেন। টাকার প্রয়োজনেই রামরতনবাবু ভেবে ভেবে একটা দুঃসাহসিক অত্যাশ্চর্য, অভূতপূর্ব খেলার প্রদর্শনী করবেন বলে বিজ্ঞাপন দিলেন।

খেলাটা হল জীবন্ত মানুষ ভক্ষণ। এই খেলা কেউ কখনও যে দেখেননি, এমন কি, শোনেনগুনি! তাই, নতুন খেলা দেখবার জন্য নানান বয়সের, নানান মানসিকতার বহু লোক টিকিট কেটে হলে এসেছেন। সমস্ত আসন ভর্তি হয়ে যায়। হাজারের উপরে আয় হতেই অনুমান ক’রে রামরতনবাবু নিশ্চিন্ত হয়ে খেলা দেখাতে লাগলেন।

প্রথমদিকে সাধারণ কিছু খেলা, যেমন তাসের খেলা, ভৌতিক ফুলগাছ জন্মানো, দর্শকের ঘড়ি চূর্ণ করে অক্ষত অবস্থার ফেরত দেওয়া, কুলদাচরণকে হিপনটাইজ ক’রে চোখ বাঁধা অবস্থায় তাকে দিয়ে দর্শকদের লিখিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ানো ইত্যাদি। এরপর শুরু হল আকঙ্ক্ষিত খেলা—মনুষ্য ভোজন।

 রামরতন প্রথমে একটু বক্তৃতা ক’রে নিয়ে দর্শকদের মধ্যে থেকে একজনকে ডাকলেন—( -যে ভক্ষিত হতে চান। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করা হল। কিন্তু কেউ এলেন না। রামরতন সাহস দিলেন, অক্ষত অবস্থায় বাঁচিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। শেষ পর্যন্ত, বন্ধুদের ঠেলায় একটা স্কুলে পড়া ছেলে মঞ্চে উঠে এল। রামরতন ছেলেটির উর্ধাঙ্গের বস্ত্র খুলে দাঁড়াতে বললেন। ছেলেটি সেভাবেই দাঁড়ালো বটে, কিন্তু ভয়ে তার পা কাঁপতে লাগলো।

 রামরতন বললেন, “দেখুন ভদ্র মহোদয়গণ, আমি এই বালককে ভক্ষণ করি” জিভ্ বেব ক’রে ওষ্ঠাধর সিক্ত করতে করতে ছেলেটার কাছে গিয়ে তার স্কন্ধে একটা কামড় বসিয়ে দিলেন।বলাইবাহুল্য, কামড় খেয়ে ছেলেটা আর্তনাদ ক’রে উঠল। সকলে ভেবেছিলেন, ম্যাজিকের সাহায্যে খাওয়া হবে। যাকে খাওয়া হবে, তার কোনো যন্ত্রণা হবে না। কিন্তু, এভাবে কামড়ে খেলে ছেলেটা যন্ত্রণা সহ্য করবে কী করে? কয়েকটি ছেলে উঠে এভাবে খাওয়ার প্রতিবাদ করল।

 রামরতনবাবু জানালেন, কামড়ে না খেলে খাবেন কী করে? অত বড়ো ছেলেটাকে তো আর গপ ক’রে গিলে খেতে পারেন না। প্রথমে তো কামড়ে কামড়ে খাবেন, তারপর ম্যাজিকের সাহায্যে বাঁচিয়ে দেবেন।

ছেলেটা এক কামড়ের জ্বালা টের পেয়েছে। আরো অসংখ্য কামড় এবং পরিণতি কল্পনা করে মঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়। দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ ক্রুব্ধ হন, তাঁদের ঠকানো হয়েছে ব’লে প্রতিবাদে সোচ্চার হন। দেখে নেবার হুমকিও দেন। ভয়ে রামরতন পুলিশ সুপারের সাহায্য নেই। সুপারের নির্দেশেই হল ফাঁকা হয়ে যায়।

গল্পের চতুর্থ পরিচ্ছেদ টান-টান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। তবে অবাঞ্ছিত বা অবিশ্বাস্য কিছু দেখানো, হয়নি। রামরতনের পরিকল্পনায় দর্শকদের ফাঁকি দেবার ইচ্ছেটা ছিল, কিন্তু সব ম্যাজিকের তা থাকে। তাই, দর্শকরা তাঁকে জোচ্চার বললেও আমরা তাকে অপরাধী বলবো না। পরিস্থিতিটা উপভোগ করি। রামরতনের প্রতি সহানুভূতিও আমাদের থাকে। ছোটগল্প হিসেবে ‘বাজীকর’ খুবই সার্থক, তা’ স্বীকার করতেই হবে।

প্রশ্ন ২। ‘বাজীকর’ গল্পের বাজীকর কে? তিনি আর কী নামে পরিচিত? তার চরিত্রটি কতটা উপভোগ্য হতে পেরেছে, আলোচনা করো।

উত্তর। ‘বাজীকর’ গল্পের বাজীকর হলেন শ্রীরামরতন বসু। তিনি প্রফেসর বোস নামেও পরিচিত।

‘বাজীকর গল্পের নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্র রামরতন বসু। অভিনব একটি চরিত্র। গল্পকার যথেষ্ট মনোযোগ ও সহানুভূতির সঙ্গে চরিত্রটি অঙ্কন করেছেন। বয়স ষাটের বেশী। গালের মাংস ঝুলে গেছে, চুল ও গোঁফ সাদা। দেহের বর্ণ আগে উজ্জ্বল ছিল, এখন মলিন। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। এককালে হয়তো সুপুরুষ ছিলেন, এখন লাঠির সাহায্যে কুজো হয়েই চলেন।

বাজীকর অর্থাৎ ম্যাজিসিয়ান রামরতনের ম্যাজিক শেখার প্রসঙ্গে যেটুকু বলা হয়েছে, তাতেই বুঝি প্রথম যৌবনে তিনি বার মুখোছিলেন। ঘর পালিয়ে কোনো এক ভুরা খাঁও তাঁর ভাই চাঁদ খাঁর ম্যাজিক দলে সাগরেদি ক'রে ম্যাজিক দেখেন। তার পরে ঘরে ফিরে আসলে অভিভাবকগণ তাঁকে ঘর মুখো করার জন্য বিবাহ দেন। 

বিবাহের পর তিনি ঘরে থাকেন বটে, কিন্তু সংসারের শ্রীবৃদ্ধিতে মন দেন না। পৈতৃক বিষয়-আসয় যা ছিল, তাতে সংসার নির্বাহ হচ্ছিল। কিন্তু বসে খেলে তো রাজার ধনেও কুলায় না। প্রথমা পত্নী তিন কন্যার জন্ম দিয়ে মারা গেলে কন্যাদের সামলাবার জন্য দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন? সেও দুষ্টি কন্যা উপহার দেয়। পঞ কন্যার সংসার চলেছে পৈতৃক সম্পত্তি ভাঙিয়ে।

মেয়েরা বড়ো হলে তিন কন্যার বিবাহ দিতেই পৈতৃক বিষয় সব শেষ। এবার সংসার চলবে কীভাবে? বাকি দুই কন্যার বিবাহ দেবেন কীভাবে? তাই, বাজী দেখানোকেই পেশা ক'রে নেন। প্রথমদিকে ভালোই আয় ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছু সঞ্চয় করার তাগিদ নিয়ে রামরতন বেশি রোজগারের চেষ্টা করতেন না। তাই, ম্যাজিক দেখার আগ্রহ মানুষর মধ্যে থেকে কমে গেলে রামরতন দরিদ্র হতে থাকেন। এই দরিদ্র রামরতনের অর্থনৈতিক সংকট নিয়েই গল্প।

দুই মেয়েরই বিবাহের বয়স পেরিয়ে গেছে। বড়টার এই বোশেখে না দিলেই নয়। কিন্তু টাকার জোগাড় হয় না। একালের ছেলেগুলো ম্যাজিক আর দেখতে চায়না। নানা ভাবে বিজ্ঞাপন দিয়েও হল ভরানো যায় না। এদিকে স্ত্রী চিঠিতে জানিয়েছে, মেয়েটার ক'দিন জ্বর, অর্থাভাবে তার চিকিৎসা হচ্ছে না। নিজে একবার গেলে ভালো হয়। কারো হাত দিয়ে অন্তত, পঁচিশটা টাকা যেন পাঠানো হয়।

চিন্তার উপর চিন্তা। আদরের মেয়ের রোগ শয্যায় যেন চোখের সামনে ভাসতে লাগল। চোখে জল এল। ভাগনে কুলদা তা দেখে কারণ জানতে চাইলে রামরতন চিঠিটা তার হাতে দেন। পড়ার পর সে জানায়, তহবিলে মোটে তিরিশ টাকা আছে। এখানকার দেনা মেটাতেই তা শেষ হয়ে যাবে। রামরতন মেয়ের অসুস্থতার কথাকেই গুরুত্ব দিলেন এবং পঁচিশ টাকা মণিঅর্ডারে বাড়িতে পাঠাবার নির্দেশ দিলেন? এখানকার উপায় উপরওয়ালার মর্জি মতো হবে।

উপরওয়ালার দিকে আঙুল দেখালেও রামরতন দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারেন নি। সারারাত ভেবেও উপার্জন বাড়াবার জন্য উপায় না দেখতে পেয়ে মরিয়া হয়ে এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিলেন। আগামীকাল রংপুরে শেষ খেলা দেখাবেন এবং সেখানে এমন এক খেলা দেখাবেন, যা ইতিপূর্বে কেউ দেখে নি। রামরতনও এ খেলা কখনো দেখান নি। তিনি যে এমন খেলা দেখাতে পারেন, সে কথা সহকারী বুলদাচরণকেও কখনো বলেন নি। সেই অভিনব খেলাটি ছিল প্রকাশ্যে জীবন্ত মনুষ্য ভক্ষণ। এটা কি সম্ভব। সংশয় চলে কুলদার মনেও। শেষকালে একটা ধাষ্টোমো না হয়।।

প্রকাশ্যে মনুষ্য ভক্ষণ সম্ভব নয়, তা' রামরতনও জানেন। জাদু তো সত্যি নয়। কথায় আর কায়দায় লোক ঠকানোই। তবে আর একভাবে লোক ঠকিয়ে যদি কিছু উপার্জন করা হয়, সে আর এমন কী দোষের হবে। অনেক ভেবেই কথা সাজিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপাতে দিলেন। মানুষ অসন্তোষ প্রকাশ করলে কী বলবেন, তাও ভেবে রাখলেন।বিজ্ঞাপন প্রচারের সময়ই বোঝা গেছে মনুষ্য ভোজন দেখবার জন্য প্রচুর মানুষ আসবে।

রামরতন দু টাকা, এক টাকার সিট বাড়িয়ে দিয়ে আট-আনা, চার আনার সিট কমিয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। তবু হল ভরে গেল। সমস্ত টিকিট বিক্রি হয়ে গেল। নিশ্চয় অনেক টাকা হাতেও এল। এটাই তো চেয়েছিলেন রামরতন। বাধ্য হয়েই চেয়েছিলেন। 

আগে তো চান নি এমনটা। খেলা আরম্ভ হ'লে প্রথমে পরিচিত কয়েকটা খেলা দেখিয়ে সময় কাটালেন। মামুলি খেলাগুলো নিয়েই ৯-টা বাজিয়ে দিলেন। তারপর ঘোষণা করলেন কাঙ্ক্ষিত খেলার কথা—মনুষ্য ভোজন। বেশ খানিকটা বক্তৃতা দিয়ে দর্শকের মন প্রস্তুত করলেন। বললেন, একটি মনুষ্যকে আপনাদের সমক্ষে ক্রমে ক্রমে আমি সম্পূর্ণরূপে ভক্ষণ করিয়া ফেলিব এবং অবশেষে উহাকে অক্ষত দেহে আপনাদের নিকট উপস্থিত করিব। দর্শকদের মধ্যে যে ভক্ষিত হতে ইচ্ছুক, তাকে মঞ্চে আসার আহ্বান জানালেন।

অনেক ডাকাডাকির পর একটি স্কুলের ছাত্র এলেও ভয়ে কাঁপতে থাকে। এটাই স্বাভাবিক। এটাই রামরতন চাইছিলেন। তার জামা খুলিয়ে মঞ্চে দাঁড় করালেন। তারপর কচি মাংস খাবার লোভ প্রকাশ করে ঘাড়ে একটা কামড় বসালেন। 

এমনটা কেউ আশা করেননি। প্রতিবাদ উঠলেও রামরতন তাদের বুঝিয়ে বলেন, কীভাবে কামড়ে কামড়ে, একটু একটু করে বালকটাকে খাবেন, তারপর ইন্দ্রজালের সাহায্যে বাঁচাবেন। একটা কামড়েই যে ছেলে বুঝতে পারে যন্ত্রণা কেমন, সে কি আরো অনেক যন্ত্রণা খেতে চায়। তাই লাফ দিয়ে মঞ ছেড়ে পালিয়ে যায়। মনুষ্য ভোজনের খেলাও বন্ধ হয়ে যায়। হাঙ্গামার ভয়ে রামরতন দর্শক পুলিশ সুপারের সাহায্য চান। 

রামরতন যে জেনে শুনেই এই পরিকল্পনা করেছেন, তা বুঝতে পেরে সুপার তাঁকে বলেন, “তুমি বড় শয়তান আছ!...তোমার বয়স কম হইলে, আমি টোমায় পুলিশের ভারোগা কার্য্য দিট?” রামরতন শয়তান নন, তবে অনন্যোপায় হয়ে এই শয়তানিটা করেছে। আর এইটুকুর জন্যই চরিত্রটি আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে।

Post a Comment

0 Comments